প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

প্রতিবেদন লেখার নিয়ম কিন্তু, প্রায়শই লেখার দরকার হয়না বলে অনেকেই প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ও ফরম্যাট নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। তাছাড়া, বিষয় সাপেক্ষে প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ও ফরম্যাট পরিবর্তন হয়, তাই Report Writing কৈাশল মনে রাখা বেশ কষ্টকরই বটে। একনজরে সম্পূর্ণ আর্টিকেল

প্রতিবেদন কি | What is Report Writing?

পূর্বে আমরা দরখাস্ত লেখার নিয়ম নিয়ে জেনেছি। আজ এখানে আমি বিভিন্ন ধরনের protibedon lekhar niyom, বিভিন্ন প্রতিবেদন যেমন প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন, সংবাদ প্রতিবেদন লেখার নিয়ম, তদন্ত প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ও নমুনা এবং প্রতিবেদন লেখার কৌশল বর্ণনা করার চেষ্টা করবো ইন-শা-আল্লাহ।

প্রতিবেদন কি | What is Report Writing?

প্রতিবেদন বলতে কোন নির্দিষ্ট বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত অনুসন্ধান ভিত্তিক বিবরণী বোঝায়। এর ইংরেজি প্রতিশব্দ Report। যিনি প্রতিবেদন রচনা করেন, তাকে বলা হয় প্রতিবেদক।

প্রতিবেদকের দায়িত্ব হল কোন ঘটনা, তথ্য বা বক্তব্য সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত, সিদ্ধান্ত, ফলাফল ইত্যাদি খুঁটিনাটি অনুসন্ধানের পর বিবরণী তৈরি করে কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা কোন কর্তৃপক্ষের বিবেচনার জন্য পেশ করা।

মূলত সংবাদপত্র বা  সংবাদমাধ্যমে প্রকাশের উপযোগী তথ্য সমৃদ্ধ সহজ সরল ভাষায় সংবাদ পরিবেশন করাকে বলা হয় প্রতিবেদন। সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সহজ-সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় সঠিক তথ্য দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে পাঠক-কে একটি সুস্পষ্ট ধারনা দিতে হয়।

অর্থাৎ, প্রতিবেদন হলো কয়টি সুসংগঠিত তথ্যগত বিবৃতি যা কোন বক্তব্য সম্বন্ধে সংক্ষিপ্ত অথচ সঠিক বর্ণনা বিশেষ। একে যথেষ্ট সতর্কতা, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, গবেষনা ও বিচার বিশ্লেষণের পর তৈরি করতে হয়। প্রতিবেদনের মাধ্যমে কোন বিষয়ে সত্যনিষ্ঠ তথ্য দ্বারা সুসজ্জিত করে পুণরায় উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

প্রতিবেদন কত প্রকার?

প্রতিবেদনের নির্দিষ্ট কোনো শ্রেণি বা প্রকারভেদ নেই। প্রতিবেদন বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। বিষয়ের বৈচিত্র্য অনুযায়ী প্রতিবেদনের নানা বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। প্রতিবেদন সাধারণত নিচে উল্লিখিত বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে।

1. সংবাদ প্রতিবেদন

সংবাদপত্রে বা ম্যাগাজিনে প্রকাশের জন্য যে প্রতিবেদন লেখা হয় তাই সংবাদ প্রতিবেদন।

2. প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন

কোনো প্রতিষ্ঠানের মাসিক, ষান্মাসিক বা বার্ষিক অর্জন, কর্মপরিকল্পনা ইত্যাদি নিয়ে যে প্রতিবেদন হয়, তাই প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন।

3. অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন

নামে অপ্রাতিষ্ঠানিক হলেও এটাকে একরকম খসড়া প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন বলা যেতে পারে। অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদনের থেকে ছোট আকারের হয়ে থাকে।

4. দাপ্তরিক প্রতিবেদন

প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনা, স্থান, অবস্থা প্রভৃতি বিষয় যাচাই করে এই সম্পর্কিত তথ্য, তত্ত্ব-উপাত্ত তুলে ধরা হয় যে প্রতিবেদনে তাকে দাপ্তরিক প্রতিবেদন বলা হয়ে থাকে।

5. তদন্ত প্রতিবেদন

কোনো ঘটনার সাপেক্ষে ঘটনার সত্য-মিথ্যা বা গভীরতা যাচাইয়ের লক্ষ্যে যে প্রতিবেদন লেখা হয় তাকে বলে তদন্ত প্রতিবেদন। তদন্ত প্রতিবেদনে প্রতিবেদকের পর্যবেক্ষণের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। তাই এই ধরনের প্রতিবেদন গতানুগতিক সংবাদ প্রতিবেদন থেকে আলাদা।

6. গবেষণামূলক প্রতিবেদন

কোনো বিষয়ের ওপর গবেষণা বা জরিপ করার পরে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তাকে গবেষণা প্রতিবেদন বলা হয়ে থাকে। গবেষণা প্রতিবেদন অনেক বেশি তথ্য ও উপাত্ত সংবলিত হয়ে থাকে। গবেষণা প্রতিবেদনে ব্যক্তি অর্থাৎ গবেষক বা প্রতিবেদকের মতামতের খুব বেশি প্রতিফলন থাকে না।

7. প্রস্তাবনা প্রতিবেদন

কোনো সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো পদ্ধতি বা প্রকল্প প্রণয়নের লক্ষ্যে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয় তাকে প্রস্তাবনা প্রতিবেদন বলা হয়ে থাকে। প্রস্তাবনা প্রতিবেদন প্রকল্পের ভালো ও মন্দ উভয় দিক পর্যালোচনা করে লেখা হয়ে থাকে।

8. ঘোষণা প্রতিবেদন

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পণ্য, সেবা বা সমস্যা সংক্রান্ত ঘোষণা দেওয়ার জন্য যে প্রতিবেদন লিখে তাকে ঘোষণা প্রতিবেদন বলে।

9. নিয়মিত প্রতিবেদন

একটি নির্দিষ্ট সময় ব্যবধানে কোনো ঘটনা বা কোনো বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন রচিত হলে তাকে নিয়মিত প্রতিবেদন বলে। নিয়মিত প্রতিবেদনের মধ্যে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, বাৎসরিক ইত্যাদি প্রকরণ রয়েছে।

10. বিশেষ প্রতিবেদন

কোনো প্রতিবেদনকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে প্রচার করা হলে সেটিকে বিশেষ প্রতিবেদন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বিশেষ প্রতিবেদন সাধারণত সময় সংবেদী হয়ে থাকে।

11. সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন

কোনো বিশেষ ব্যক্তির সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন রচিত হলে তাকে সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রতিবেদন বলা হয়ে থাকে।

12. রাজনৈতিক প্রতিবেদন

কোনো রাজনৈতিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন রচিত হলে তাকে রাজনৈতিক প্রতিবেদন বলে।

13. সাংস্কৃতিক প্রতিবেদন

সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠান বা আয়োজনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদন রচিত হলে তাকে সাংস্কৃতিক প্রতিবেদন বলে।

প্রতিবেদন লেখার জন্য সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। প্রতিবেদন লেখার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট কাঠামো। যে ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রতিবেদন লেখা হবে সেই ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত বক্তব্য যুক্তিসহকারে লিখতে হবে। প্রতিবেদন লেখার সময় সবচেয়ে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল: প্রতিবেদনটি নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে লিখতে হবে। যেখানে প্রতিবেদকের নিজস্ব আবেগ-অনুভূতির কোনো স্থান থাকবে না। ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে ঠিক সেভাবে উপস্থাপন করাই একটি মানসম্পন্ন প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য।

প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশক্রমে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন তৈরি করার ক্ষেত্রে নিচের নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে।

তারিখ: ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

বরাবর,

চেয়ারম্যান (যার কাছে প্রতিবেদন পেশ করা হবে তার পদবী)

প্রতিষ্ঠানের নাম

প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা।

বিষয় : ___________________________________________________ বিষয়ে প্রতিবেদন।

সূত্র/স্মারক নং: জেবিএল/সিএডি/প্রতিবেদন/২০২১-১ তারিখ: ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।

জনাব,

বিনীত নিবেদন এই যে, আপনার আদেশ নং জেবিএল/সিএডি/প্রতিবেদন/২০২৪-১ তারিখ: ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ অনুসারে (বিষয়ে যা লিখেছেন তা লিখবেন) … … … উপলক্ষে প্রতিবেদনটি নিম্নে পেশ করছি।

(প্রতিবেদনের শিরোনাম)

বিবরণ: প্রয়োজন অনুসারে ৩/৪টি অনুচ্ছেদ।

মতামত:

প্রতিবেদকের স্বাক্ষর

প্রতিবেদনের বিষয়

প্রতিবেদনের সময়

প্রতিবেদনের তারিখ

প্রতিবেদনের স্থান

প্রতিবেদকের নাম ও ঠিকানা

প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন লেখার নমুনা

 

প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

সংবাদ প্রতিবেদন লেখার নিয়ম | Newspaper Report Writing

সংবাদ প্রতিবেদন প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন থেকে পুরোপুরি ভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদনের জন্য একটি সুন্দর শিরোনাম দরকার হয়। শিরোনামটি খুবই গুরুত্ব বহন করে। খবরের মূল কথাটি শিরোনামের মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। একজন পাঠক সংবাদটি পড়বেন কিনা সেই সিদ্ধান্ত নির্ভর করে শিরোনামের ওপর। তাই শিরোনামটি আকর্ষণীয় এবং সংক্ষিপ্ত অথচ মূলভাব প্রকাশ করে এমন হতে হয়।

শিরোনাম লেখার পরে আসে প্রতিবেদকের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। এই অংশে প্রতিবেদকের নাম বা পদবী, ঘটনার বা প্রতিবেদন তৈরির স্থান লিখতে হয়। এর পরে দুই-তিন লাইনের মধ্যে ঘটনার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিতে হয়। তারপর যেতে হয় বিস্তারিত অংশে।

সংবাদ প্রতিবেদন এর কাঠামো

১. শিরোনাম: প্রতিবেদন যে বিষয়ে লেখা হবে সেই বিষয়কে ভালোভাবে প্রকাশ করে এমন একটি শিরোনাম লিখতে হবে। শিরোনামটি কোনোভাবেই দীর্ঘ হওয়া যাবে না।

২. ভূমিকা: ভূমিকা অংশে খবরের মূলভাবটা তিন-চার লাইনের মধ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে। এই অংশটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে, কারণ এই অংশ যদি আকর্ষণীয় হয় তাহলে পাঠক মূল লেখা পড়তে আগ্রহী হবেন। তাই পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখতে ভূমিকা অংশে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।

৩. সূত্র: কোনো বিজ্ঞপ্তির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন লেখা হলে সেই বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সূত্র এ অংশে লিখতে হবে।

৪. ব্যক্তিনাম পরিহার: প্রতিবেদনে ব্যক্তিনাম পরিহার করতে হয়। ব্যক্তিনামের পরিবর্তে পদমর্যাদা (সচিব, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক), সাধারণ পরিচয় যেমন: বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা, কারখানার শ্রমিকেরা কিংবা ভুক্তভোগী এলাকাবাসী, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ব্যক্তি ইত্যাদি ব্যবহার করতে হয়। এতে করে সংবাদে আলোচ্য ঘটনার সাথে ব্যক্তির সম্পৃক্ততা ভালোভাবে বোধগম্য হয়।

৫. বিবিধ তথ্য: সংবাদ প্রতিবেদনে স্থান, কাল ইত্যাদি তথ্য যথাযথভাবে দিতে থাকতে হবে।

তদন্ত প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

সাধারণ প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিবেদন লেখার নিয়মের সাথে তদন্ত প্রতিবেদন লেখার আংশিক মিল রয়েছে। তবে সংবাদ প্রতিবেদনের সাথে এটা মিলবে না। এতে লেখকের ব্যক্তিগত মতামতের গুরুত্ব রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে লেখকের অবজারভেশন তথা পর্যবেক্ষণ একটা বড় ভূমিকা পালন করে। দায়িত্ব প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের সমীপে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনের ভূমিকায় ঘটনা ও ঘটনার কার্যকারণ ব্যাখ্যা করার পর ঘটনার পুুনরাবৃত্তি নিরসনকল্পে করণীয় সম্পর্কে প্রতিবেদককে সুপারিশ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, মহাসড়কের কোন একটি স্থানে বার বার সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটে থাকে। এই নিয়ে তদন্ত করা হলে নিম্নরূপে একটি প্রতিবেদন করা যেতে পারে।

 

প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

ফলোআপ প্রতিবেদন লেখার নিয়ম

ফলোআপ প্রতিবেদন বলতে বোঝায় পূর্বে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনার বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করে যে প্রতিবেদন লেখা হয়। ফলোআপ প্রতিবেদনের শেষদিকে অনুচ্ছেদে ঘটনাটি রিক্যাপ করা বা পুনরায় সংক্ষেপে বর্ণনা করতে হবে। দীর্ঘ বিলম্বিত ফলোআপ রিপোর্টে মূল ঘটনাটি কবে, কোথায়, কীভাবে ঘটেছিল তা উল্লেখ করে দিলে পাঠকের স্মরণ করতে সুবিধা হবে।

কোনো সমীক্ষা উল্লেখ করলে তা কীসের, কবেকার এবং কী পদ্ধতিতে তৈরি তা উল্লেখ করা জরুরি।

একজন গবেষকের গবেষণার ফলাফল কিংবা একটি প্রবন্ধের তথ্য নিয়েও রিপোর্ট করা যেতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে প্রবন্ধে উল্লেখিত সমস্যা-সম্ভাবনা-পরিসংখ্যান সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বক্তব্য বা কোনো পাঠকের মন্তব্য নিয়ে খবর বানাতে হবে।

প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা

বর্তমানের আধুনিক বিশ্বে প্রতিবেদনের প্রয়োজনীয়তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নির্দিষ্ট কোনো বিষয় সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য প্রতিবেদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

বর্তমানে প্রতিবেদন মানে শুধু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনকেই বোঝায় না। প্রতিবেদনের পরিধি আরো ব্যাপক। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরকারি অফিস আদালতে প্রতিবেদনের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। এসব ক্ষেত্রে প্রতিবেদন দৈনন্দিন কাজকর্মকে সহজ করেছে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক পরিকল্পনা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজতর হয়েছে প্রতিবেদনের কল্যাণে।

সংবাদপত্রের প্রতিবেদন আমাদের নিত্যদিনের জাতীয় ও বৈশ্বিক অবস্থা সম্পর্কে অবহিত করে। পত্রপত্রিকার পাতায় পড়া প্রতিবেদন আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।

প্রতিবেদন কাজের সমন্বয় সাধন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে, কোনো কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদান করে। সেইসাথে কাজটির সফলতা বা ব্যর্থতা নিরূপণ করে।

প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য

একটি ভালো প্রতিবেদন লেখার জন্য প্রতিবেদন লেখার নিয়মকানুন জানা থাকা জরুরি। অপ্রয়োজনীয় বাক্য পরিহার করে তথ্য ও উপাত্তের সমন্বয় একটি ভালো প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য। নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রতিবেদন লেখার ক্ষেত্রে প্রতিবেদনের ফরম্যাট, আকার, শ্রেণি, পাঠকের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারা জরুরি।

প্রতিবেদনে ধরাবাঁধা কোনো আকার নেই। তবুও কোনো বিষয় সম্পর্কে পাঠক ভালোভাবে অবহিত হওয়ার জন্য কতটুকু বর্ণনা জরুরি তা বুঝতে পারা একজন ভালো প্রতিবেদকের গুণ। বিষয়ের গুরুত্ব ও পরিধি অনুসারে প্রতিবেদনের আকার বড়, ছোট বা মাঝারি হতে পারে। এই লেখায় প্রদত্ত প্রতিবেদন লেখার নিয়ম অনুসরণ করলে একটি ভালো মানের প্রতিবেদন লেখা সম্ভব।

কখনো কখনো খুব বেশি বড় আকারের প্রতিবেদনকে পুস্তক আকারে প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সারণি, চিত্র, নকশা, ছক ইত্যাদির সমন্বয় সাধন করা হয়ে থাকে।

সুন্দর প্রতিবেদন লেখার কৌশল

একটি সুন্দর প্রতিবেদন লেখার জন্য প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুর ওপর ভালো ধারণা থাকা জরুরি। এজন্য যথাযথভাবে প্রতিবেদন লেখার নিয়ম অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই। নিয়মিত অধ্যবসায়ের সাথে প্রতিবেদন লেখার চর্চা করা হলে প্রতিবেদন চমৎকার প্রতিবেদন লেখার দক্ষতা অর্জন করা সম্ভব।

উপরে প্রদত্ত প্রতিবেদন লেখার ফরম্যাট অনুসরণের পাশাপাশি নিচে উল্লিখিত বিষয়সমূহ খেয়াল করলে ভালো প্রতিবেদন লেখা সম্ভব।

প্রতিবেদন লেখার সময় লক্ষণীয় বিষয়সমূহ

1. সুনির্দিষ্ট কাঠামো

প্রতিবেদন লেখার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম ও কাঠামো অনুসরণ করা জরুরি। একেক ধরনের প্রতিবেদনের জন্য একেক ধরনের কাঠামো অনুসরণ করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের কাঠামো এই লেখায় ইতোমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে।

2. নির্ভুল তথ্য

প্রতিবেদন রচিত হবে সঠিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে। তথ্যানুসন্ধানই হল প্রতিবেদনের প্রধান কাজ। সেজন্য তথ্যের যথার্থতার ওপর বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কোনো নির্দিষ্ট ঘটনা বা বিষয় অবলম্বনে রচিত প্রতিবেদনটি বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর হতে হবে।

পাঠকের মনোরঞ্জনকারী তথ্য প্রদানের পূর্বে প্রতিবেদককে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে। বর্ণনা যাতে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং অতিমাত্রায় ব্যাখ্যামূলক না হয়।

প্রতিবেদন পড়তে পড়তে যতই সামনে এগুনো হোক, কখনোই যেন মনে না হয় যে- প্রতিবেদনের মূল আলোচ্য বিষয় থেকে প্রতিবেদন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

3. তথ্যের পরিপূর্ণতা

প্রতিবেদন যেসব তথ্য পরিবেশিত হবে তা হতে হবে নির্ভুল, সম্পূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য। এতে প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত আবেগ স্থান পাবে না।

4. বক্তব্যের স্পষ্টতা

প্রতিবেদকের বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টতা থাকবে যাতে বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা লাভ করা সহজ হয়। সংবাদের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অর্থাৎ খবর হিসেবে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা-ই প্রতিবেদনে স্থান পাবে।

5. সংক্ষিপ্ততা

প্রতিবেদন হবে বাহুল্যবর্জিত। বক্তব্য হবে সুনির্বাচিত এবং কোন অনাবশ্যক বক্তব্য সংযোজিত হতে পারেনা। অযাচিত বক্তব্য যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে। ভাষায় গতিশীলতা না থাকলে ভালো প্রতিবেদন লেখা হয় না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য দিয়েই সূচনাটি সাজানো যায়। অর্থাৎ সূচনাটি হবে সংক্ষিপ্ত কিন্তু অনেক বেশি সমৃদ্ধ। অর্থাৎ প্রতিবেদন যাতে খাপছাড়া না লাগে। খুঁটিনাটি অপ্রয়োজনীয় তথ্য বেশি দিয়ে প্রতিবেদন বড় করার প্রবণতা পরিহার করতে হবে।

6. সুন্দর উপস্থাপনা

প্রতিবেদনের উপস্থাপনা হতে হবে আকর্ষণীয় ও পরিপাটি। এর বক্তব্য সহজ সরল ভাষায় প্রকাশ পায় যেন তা সকলের বোধগম্য হয়। অপ্রচলিত বা সাধারণের কাছে অপরিচিত শব্দ ব্যবহার করার মনোভাব ত্যাগ করা উচিৎ। এতে প্রতিবেদনের প্রাঞ্জলতা নষ্ট হয়।

7. ভাষার দুর্বলতা নয়

প্রতিবেদনে প্রচলিত ধারার কাঠামো ও বিন্যাস অনুসরণই যথেষ্ট নয়, ভাষার দুর্বলতাও থাকা যাবে না। ভেতরে অপ্রয়োজনীয় কথা রেখে প্রতিবেদনকে মেদযুক্ত বানানোর দরকার নেই। শিরোনামের মধ্যে প্রতিবেদকের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। অতিরিক্ত ও ভুল শব্দ ব্যবহার মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই তথ্য বারবার দেওয়া যাবে না।

8. সুপারিশ

প্রতিবেদনে উপসংহারে সুপারিশ সংযোজন করতে হবে যাতে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সমস্যা সম্পর্কে সিদ্ধন্ত গ্রহণ করতে পারে। প্রতিবেদনের মন্তব্য বা সুপারিশ হতে হবে সহজ-সরল, নিরপেক্ষ, যুক্তিযুক্ত ও বাহুল্যবর্জিত। প্রতিবেদকের কাছে বিশেষভাবে প্রত্যাশিত যে, তার সংবাদ পারতপক্ষে এমন কোনো বিশেষণ ব্যবহার করবে না, যার ফলে তার রচনা পক্ষপাতদুষ্ট মনে হয়।

9. তথ্যসূত্র উল্লেখ

অফিসিয়াল সূত্রের বক্তব্য উল্লেখ করতে পারাটা ভালো। সূত্র নির্ভরযোগ্য না হলে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার সময় সচেতন থাকতে হবে। গুরুতর অভিযোগ থাকলে অপরাধ প্রতিবেদন রচনার কলাকৌশল যথাযথভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন।

10. কখনোই ঢালাও মন্তব্য নয়

সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া কখনোই ঢালাও মন্তব্য করা ঠিক নয়; ঢালাও মন্তব্যে প্রতিবেদন দৃঢ় হয় না, নানান বিপদ আসতে পারে। ঘটনার গভীরতা অনুধাবনপূর্বক শব্দচয়নে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

11. পরস্পর বিরোধী তথ্য নয়

খেয়াল রাখতে হবে প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য যাতে পরস্পর বিরোধী হয়ে না যায়। স্ববিরোধী তথ্য প্রতিবেদনের নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। তাই সঠিক তথ্যটি যাচাই করে নিতে হবে।

12. আগ্রহ ধরে রাখা

পাঠকের আগ্রহ ধরে রাখার জন্য সচেতন থাকতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের অতি গভীরে যাওয়ার ফলে লেখা যাতে বিরক্তির সৃষ্টি না করে। বিশেষ করে ধারাবাহিক প্রতিবেদনে তথ্য ও ধারা-বর্ণনা পাঠযোগ্য ও কৌতূহলোদ্দীপক হতে হবে। প্রতিবেদনে নানা প্রশ্ন তোলাই যথেষ্ট নয়, প্রশ্নের ব্যাখ্যা বা প্রমাণভিত্তিক তথ্য থাকতে হয়। অযাচিতভাবে কোনো প্রসঙ্গ আনা যাবে না। সূচনা যে বিষয় নিয়ে করা হয়েছিল তার সাথে সম্পর্কহীন কোনো প্রসঙ্গ যাতে না আসে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপন করতে হবে, গুরুত্বহীন তথ্য তেমনই সচেতনভাবে এড়িয়ে যেতে হবে। এমন যাতে মনে না হয় যে কোনো অংশ পুরো প্রতিবেদনের সাথে বেমানান লাগছে।

13. পাঠকের জন্য সহজ করে লিখতে হবে

তথ্য বিন্যাসের ক্ষেত্রে ধারাক্রমে এগুতে হবে, যাতে পাঠক ধৈর্য না হারায়। প্রয়োজনে উপশিরোনাম ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে তা সব ধরনের প্রতিবেদনের জন্য আদর্শ বা অনুকরণীয় হবে না। চমৎকার শিরোনাম দিয়ে সংবাদ সূচনা করতে হবে, সাথে যথাযথ সূত্রের সাথে আলাপ, এক সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অন্য সূত্রের সাথে যাচাই। সাবলীল ভাষা ব্যবহার করলে সব শ্রেণির পাঠকের জন্য সুপাঠ্য হবে।

14. পক্ষপাতিত্ব করা যাবে না, অতি আবেগ পরিহার করতে হবে

প্রতিবেদক সৎ ও সংবেদনশীল হবেন, পাঠকের মন নাড়া দিতে ভাষা ব্যবহারে অতিমাত্রায় আবেগী হবেন না বা পক্ষপাতিত্ব করবেন না। প্রতিবেদকের সরাসরি মন্তব্য ও নিজস্ব পরামর্শ প্রতিবেদনে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। সংশ্লিষ্ট মহল বা পর্যবেক্ষকের নামে মন্তব্য জুড়ে দেয়া প্রতিবেদনের অঙ্গহানি করে। ভাষা ও বিশেষণের ব্যবহার যাতে এমন না হয় যে প্রতিবেদন দেখে মনে হবে প্রতিবেদক ঘটনাটিকে যেভাবে দেখতে চেয়েছেন সেভাবেই প্রতিবেদনটি সাজিয়েছেন।

15. সরাসরি অভিযোগ আনা যাবে না

যেসব প্রতিবেদনে পদে পদে মানহানি মামলার আশঙ্কা থাকে, সেসব প্রতিবেদনে সরাসরি অভিযোগ আনা রিপোর্টারের পক্ষে অনুচিত। গোয়েন্দা স্টোরি বানানো প্রতিবেদকের কাজ নয়, পুলিশি ডিটেকটিভের কাজ সাংবাদিকতার নীতি বিরুদ্ধ।

16. প্রতিবেদনের সংখ্যা ও ধরন নির্ধারণ

একটি খাতের সব সমস্যা নিয়ে একটি প্রতিবেদন যথেষ্ট নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে একটি বিশেষ সমস্যাকে মূল বিষয় ধরে সমস্যা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে প্রতিবেদন করা যেতে পারে। ছোট ছোট কয়েকটি প্রতিবেদন হতে পারে। জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো দাবি প্রতিবেদকের নিজ থেকে উপস্থাপন না করে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে উপস্থাপন করাতে হবে।

প্রতিবেদন লেখার নিয়ম নিয়ে শেষ কথা

প্রতিবেদন লেখা প্রাথমিকভাবে কিছুটা জটিল মনে হতে পারে। কিন্তু নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের প্রতিবেদন লেখা ও পড়ার চর্চা করলে প্রতিবেদন লেখার নিয়মকানুন খুব সহজেই শিখে ফেলা যাবে।

সহজে প্রতিবেদন লেখার নিয়ম শেখার জন্য চর্চার কোনো বিকল্প নেই। শুদ্ধ ভাষার ব্যবহার ও নির্দিষ্ট ফরম্যাট অনুসরণ করে সহজেই প্রতিবেদন লেখা যায়। এই লেখায় প্রদত্ত সকল প্রতিবেদন লেখার নিয়ম ও নমুনায় উল্লেখ করা বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রতিবেদন রচিত হলে আপনার প্রতিবেদনটি সকলের নিকট প্রশংসিত হবে।