নবজাতকের টিকা

সাধারণত শিশুর জন্মের প্রথম দিন থেকে ২৮ তম দিন পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় নবজাতক শিশু। কিছু নির্দিষ্ট ছোটখাটো সহজ নিয়ম-কানুন মেনে চলতে পারলেই নবজাতক শিশুকে সুস্থ রাখা সম্ভব। নবজাতক শিশুর যত্নগুলো খুবই ছোট ছোট অথচ দারুণ কার্যকর, যদি সেগুলো সঠিকভাবে মেনে চলা যায়।

যেসব নিয়ম মেনে চলা জরুরী

যেমন—

  • প্রথম ও প্রাথমিক পরিচর্যা হলো একটি নবজাতক বাচ্চাকে উষ্ণ রাখা। এমনভাবে উষ্ণ রাখতে হবে যে নবজাতক শিশুটি যেন অতিরিক্ত গরমে ঘেমে না যায়, আবার ঠাণ্ডাও না লেগে যায়।
  • বাচ্চাটি প্রস্রাব-পায়খানা করলে সঙ্গে সঙ্গে তার কাপড় পরিবর্তন করে দিতে হবে। শিশুদের ডায়াপার পরানোতে কোনো সমস্যা নেই, বরং নবজাতক শিশুটি তাতে আরামেই থাকবে। এর ফলে শিশুটির জামাকাপড় বা বিছানা ভিজে যাওয়ার এবং ঠাণ্ডা লাগার আশঙ্কাও কম থাকে। তবে কিছু ক্ষেত্রে ডায়াপারে র‌্যাশ বা অ্যালার্জি হতে পারে।
  • এর পরের যত্নআত্তি প্রতি ঘণ্টায় তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে বা যখনই শিশুটি দুধ খেতে চাইবে তখনই তাকে চাহিদামতো বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। ছয় মাস বয়স পর্যন্ত সে শুধু বুকের দুধই খাবে।
  • জন্মের পরপরই সব নবজাতক শিশুর কমবেশি ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস হয়ে থাকে এবং সেটা সাধারণত দুই-তিন সপ্তাহ পর এমনিতেই চলে যায়। এ জন্য নবজাতক শিশুকে দৈনিক আধাঘণ্টা করে রোদে রাখতে হবে টানা তিন সপ্তাহ বয়স পর্যন্ত। তাতে সে ভিটামিন ডি পাবে এবং ভিটামিন ডি ঘাটতিজনিত রোগ থেকে মুক্তি পাবে। পাশাপাশি তার জন্ডিসের প্রকোপটাও কমে আসবে।
  • নবজাতককে জন্মের পরদিন থেকে প্রতিদিন দুপুরে হালকা গরম পানি দিয়ে সারা শরীর মুছতে হবে এবং নাভি পড়ে না যাওয়া অবধি এ কাজটা অব্যাহত রাখতে হবে। অবশ্য যেদিন নাভি পড়ে যাবে তার পরদিন থেকেই গোসল করিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
  • বাচ্চার গায়ে কোনো কিছু লাগানো বা মাখানো উচিত নয়। যেমন—তেল, সাবান, কাজল, লোশন, শ্যাম্পু, ভ্যাসলিন, ক্রিম, পাউডার ইত্যাদি। তাতে নবজাতক শিশুটির গায়ে অ্যালার্জি বা স্কিন ইনফেকশন হওয়ার আশঙ্কা কম থাকবে।
  • দেড় মাস বয়স হলেই নিয়মিত টিকাদান শুরু করতে হবে। এ সময় থেকেই জীবনরক্ষাকারী ১০টা টিকা দেওয়া হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই, একটি সিরিঞ্জের ভেতরে পাঁচটি টিকা সংযুক্ত থাকে, যেটা একসঙ্গেই দেওয়া হয়।
  • বাচ্চার ত্বক বেশি হলুদ মনে হলে, প্রস্রাব হলুদ রঙের হলে অবশ্যই শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াটা উত্তম। নবজাতক বাচ্চার বয়স দুই সপ্তাহ পার হলেই রুটিন চেকআপ করিয়ে নেওয়া শ্রেয়।

টিকা দেওয়ার সময় আপনি কীভাবে আপনার শিশুকে শান্ত থাকতে সহায়তা করতে পারেন?

একজন নার্স হিসাবে আমি অনেক বাবা-মাকে দেখেছি যারা নিজেরাই এই ঘটনা নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন থাকেন যে, এক্ষেত্রে শিশুর শান্ত থাকার কোনো উপায় থাকে না। তাই এক্ষেত্রে শুধু বাবা-মাকে কয়েকবার দীর্ঘ শ্বাস নিতে বলা এবং তাদের সঙ্গে শান্ত কণ্ঠে কথা বলা এই কাজের সবচেয়ে বড় অংশ, আর এটাই সত্যি।

বাবা-মায়েদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজেদের শান্ত রাখা। কারণ বাবা-মা যদি উদ্বিগ্ন হন, তবে তা সন্তানের মাঝেও দেখা যায়।

আর তারপর আপনি শিশুদের জন্য বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করতে পারেন। যেমন, তাদের ব্যথা কমানোর জন্য টিকা দেওয়ার স্থানটি ক্রিম দিয়ে অবশ করা, টিকা দেওয়ার সময় শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো- এসব সত্যিই কার্যকর হতে পারে।

এরপরের কাজ হলো, মনোযোগ সরিয়ে নেওয়া; শিশুকে কেবল অন্য কিছু সম্পর্কে চিন্তা করতে, একটি বই বা পোস্টারের দিকে তাকাতে অথবা বুদবুদ ফোলাতে দেওয়া।

শিশুদের টিকা দেওয়া নিয়ে বাবা-মায়েদের কেন আত্মবিশ্বাসী হওয়া উচিত?

আমি বুঝতে পারি যে, বাবা-মায়েরা টিকা সম্পর্কে অনেক ভীতিকর কথা শুনতে পান। আমি জানি, তারা ইন্টারনেটে বিভিন্ন জিনিস দেখেন এবং বন্ধুদের কাছ থেকে ভীতিকর গল্প শোনেন। আমি শুধু তাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমাদের কাছে যে বিপুল তথ্য-প্রমাণ রয়েছে তা দেখায় যে, টিকাগুলো নিরাপদ ও কার্যকর। আর এগুলোই এখন পর্যন্ত শিশুদের রোগ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার সর্বোত্তম উপায়। তাই অভিভাবকদের আশ্বস্ত করা যেতে পারে যে, স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী তাদের শিশুদের টিকা দেওয়ার সময় শিশুর জন্য সবচেয়ে যেটা ভালো ঠিক সে কাজটিই করছেন।

টিকা কীভাবে কাজ করে?

টিকাগুলো যা করে তা হলো, ভবিষ্যতে মুখোমুখি হতে যাওয়া জীবাণুর জন্য আপনার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে প্রস্তুত করা। এক্ষেত্রে ধারণাটি হলো- আপনার শরীরের রোগ প্রাতিরোধ ক্ষমতা জীবাণুকে সত্যিকারভাবে দুর্বল করে দেয় এবং ভবিষ্যতে আপনাকে সুরক্ষিত রাখে। ক্ষা করবে।

শিশুকে টিকা দেওয়া এবং ভবিষ্যতে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের শরীর জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে। জীবাণুকে প্রভাব বিস্তার করতে দেওয়ার বদলে সেগুলোকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়।

শিশুদের অল্প বয়সেই টিকা নেওয়া কেন গুরুত্বপূর্ণ?

শিশুদের জন্য খুব অল্প বয়সে টিকা নেওয়া সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তখনই তারা রোগে আক্রান্ত হওয়ার সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আপনি যদি প্রথম দিকে টিকা প্রদান করেন, তাহলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং তারপর যখন তারা সেই রোগের সম্মুখীন হয়, তখন তারা লড়াই করতে সক্ষম হয়।

আর যদি শিশুকে অল্প বয়সে টিকা দেওয়া না হয় অর্থাৎ তারা অরক্ষিত থাকে, তবে তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে বেশি। এসব রোগে  ভোগার সম্ভাবনা শিশুদের অনেক বেশি  থাকে এবং এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করা অনেক সময় তাদের জন্য কঠিন হয়। তাই এটি গুরুত্বপূর্ণ যেন তারা খুব অল্প বয়সেই টিকা পায়।

টিকা কি নিরাপদ?

আমাদের শৈশবকালীন নিয়মিত টিকাদানের সূচিতে যেসব টিকা চালু রয়েছে তার সবগুলোই খুব কঠোরভাবে পরীক্ষিত এবং মানুষের জন্য টিকা চালু করার পর সেই নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন প্রক্রিয়াও চালু রয়েছে।

একটি টিকা তৈরির জন্য যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয় সেগুলো শিশুদের গ্রহণের জন্য নিরাপদ কিনা তা নিশ্চিত করতে সবগুলো উপাদানই সাবধানতার সঙ্গে পরীক্ষা করা হয়। বেশিরভাগ উপাদানই প্রাকৃতিকভাবে আপনার পরিবেশে তৈরি হয় এবং সেগুলোকে অতি অল্প পরিমাণে টিকায় ব্যবহার করা হয়।

টিকাগুলো শিশুর রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বিচলিত করে না। কারণ একটি শিশু আগে থেকেই তার পরিবেশে থাকা অনেক জীবাণুর সংস্পর্শে আসে এবং শিশুরা দৈনিক যে পরিমাণ জীবাণুর সংস্পর্শে আসে, টিকাগুলো তার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। তাই এগুলো শিশুদের জন্য ক্ষতিকারক নয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাবা-মায়েরা সাধারণত কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আশা করতে পারেন?

টিকা দেওয়ার পর কোনো শিশুর মধ্যে সাধারণত খুব সামান্যই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়, যে কারণে স্কুল বাদ দিয়ে বাড়িতে থাকার খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। এসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো, সামান্য জ্বর বা যে স্থানে টিকা দেওয়া হয়েছে তার চারপাশে লালচে বা ব্যথা হওয়া। আর এগুলো এমন বিষয় যা আপনি ঘরে বসেই সামাল দিতে পারেন।

এই ধরনের হালকা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ঠিক হয়ে যায় বা নিজে থেকেই চলে যায়। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না।

টিকার সূচিতে মেনে চলা কেন গুরুত্বপূর্ণ?

টিকার সূচি মেনে চলা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সূচিগুলো তৈরি করেছেন বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা, যারা একটি টিকা গ্রহণের সর্বোত্তম সময় এবং শিশুরা কোন কোন রোগের ক্ষেত্রে অরক্ষিত থাকে তা খুঁজে বের করেছেন।

কিছু দেশে, উদাহরণস্বরূপ, কিছু রোগ খুব বেশি দেখা যায় এবং এ কারণে শিশুদের জীবনের শুরুতেই সেই টিকাগুলো নিতে হয়। তাই টিকার সূচি মেনে চললে তা আপনার শিশুর সেই রোগগুলো থেকে সুরক্ষা দেবে, যেসব রোগে তাদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

পরামর্শ দিয়েছেন
ডা. এহসানুল কবীর
ডিরেক্টর, ডক্টরস পয়েন্ট স্পেশালাইজড হসপিটাল, খুলনা।