সহবাসের দোয়া

বিয়ে হলো: একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি যার মাধ্যমে দু’জন মানুষের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আল্লাহ তাআলা বিবাহের মাধ্যমে নারী-পুরুষের যৌন সম্ভোগ তথা বংশ বৃদ্ধিকে কল্যাণের কাজে পরিণত করেছেন। বিবাহের ফলে স্বামী-স্ত্রীর যাবতীয় বৈধ কার্যক্রম হয়ে ওঠে কল্যাণ ও ছাওয়াবের কাজ। বংশবৃদ্ধির একমাত্র মাধ্যমে হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর সহবাস। এর রয়েছে কিছু নিয়ম-নীতি ও দোয়া। আসুন জেনে নেই সহবাসের দোয়া

দোয়া কি?

দোয়া অর্থ চাওয়া, প্রার্থনা করা ইত্যাদি। অর্থাৎ সাধারণ ব্যক্তি কর্তৃক বড় কোন ব্যক্তির নিকট ভয়-ভীতি সহকারে বিনয়ের সাথে নিবেদন করা। দো’আ অর্থ ডাকা। আল্লাহ বলেন, “তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব’ (মুমিন ৬০)।

দো’আ অর্থ ইবাদত করা। আল্লাহ বলেন, “তুমি আল্লাহ ব্যতীত এমন কারো ইবাদত করো না, যে তোমার ভাল-মন্দ কিছুই করতে পারে না’ (ইউনুস ১০৬)। দো’আ অর্থ বাণী । আল্লাহ বলেন, ‘সেখানে তাদের বাণী হ’ল, “হে আল্লাহ! আপনি পবিত্র; আর তাদের শুভেচ্ছা হ’ল সালাম’ (ইউনুস ১০)।

দো’আ অর্থ আহ্বান করা। আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন তিনি তোমাদেরকে আহ্বান করবেন, অতঃপর তোমরা তাঁর প্রশংসা করতে করতে চলে আসবে’ (ইসরা ৫২)। দো’আ অর্থ অনুনয়-বিনয় করা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তোমাদের সাহায্যকারীদেরকে বিনয়ের সাথে ডাক’ (বাক্বারাহ ২৩)।

দো’আ অর্থ প্রশংসা সহকারে ডাকা । আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! আপনি বলুন, আমি আল্লাহ্র প্রশংসা করি অথবা রহমানের প্রশংসা করি’ (ইসরা ১১০; মির’আত, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৩৯৪)।

সহবাসের দোয়া ও নিয়ম কানুন :

সহবাসের দোয়া আরবিতে :

بسمِ اللهِ اللَّهُمَّ جَيِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَ جَيِّبِ الشَّيْطَانَ مَا رَزَقْتَنَا

সহবাসের দোয়া বাংলায় উচ্চারণ : বিসমিল্লাহি আল্লাহুম্মা জান্নিবনাশ শায়ত্বানা ওয়া জান্নিবিশ শায়ত্বানা মা রাযাক্বতানা।

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! তোমার নামে আরম্ভ করছি, তুমি আমাদের নিকট হতে শয়তানকে দূরে রাখ। আমাদের এ মিলনের ফলে যে সন্তান দান করবে, তা হতেও শয়তানকে দূরে রাখ।’

সহবাসের দোয়া বাংলায় ফজিলত:

হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন তোমাদের কেউ আপন স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার ইচ্ছা করে তখন উক্ত দোয়া পড়ে যেন মিলিত হয়। এ মিলনে যদি তাদের কিসমতে কোনো সন্তান আসে, সে সন্তানকে শয়তান কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)।

হজরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, যে ব্যক্তি সহবাসের ইচ্ছা করে, তার নিয়্যাত যেন এমন হয় যে, আমি ব্যভিচার থেকে দূরে থাকবো। আমার মন এদিক ওদিক ছুটে বেড়াবে না আর জন্ম নেবে নেককার ও সৎ সন্তান। এই নিয়্যাতে সহবাস করলে তাতে সওয়াব তো হবেই সঙ্গে সঙ্গে নেক উদ্দেশ্যও পূরণ হয়।

স্ত্রী সহবাসের রয়েছে কতিপয় নিয়ম-

  • স্বামী-স্ত্রী উভয়ই পাক পবিত্র থাকবে।
  • “বিসমিল্লাহ” বলে সহবাস শুরু করা মুস্তাহাব। ভুলে গেলে যদি বীর্যপাতের পূর্বে স্মরণ হয় তাহলে মনে মনে পড়ে নিতে হবে।
  • সহবাসের পূর্বে সুগন্ধি ব্যবহার করা। যা আল্লাহর রাসুলের সুন্নাত।
  • সব ধরনের দুর্গন্ধ জাতীয় জিনিস পরিহার করা। উল্লেখ্য যে, ধূমপান কিংবা অপরিচ্ছন্ন থাকার কারণে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়। আর এতে কামভাব কমে যায়। আগ্রহের স্থান দখল করে নেয় বিতৃষ্ণা।
  • কেবলামুখি হয়ে সহবাস না করা।
  • একেবারে উলঙ্গ না হওয়া।
  • স্ত্রীকে পরিপূর্ণ তৃপ্তি দান করার পূর্বে বিচ্ছিন্ন না হওয়া৷
  • বীর্যপাতের সময় মনে মনে নির্ধারিত দোয়া পড়া। কেন না যদি সে সহবাসে সন্তান জন্ম নেয় তাহলে সন্তান শয়তানের প্রভাব মুক্ত থাকবে।
  • স্ত্রীর হায়েজ-নেফাসের (ঋতুকালীন) সময় সহবাস না করা।
  • চন্দ্র মাসের প্রথম এবং পনের তারিখ রাতে মিলিত না হওয়া।
  • স্ত্রীর জরায়ুর দিকে চেয়ে সহবাস না করা।
  • বিদেশে বা সফরে যাওয়ার আগের রাতে স্ত্রী সহবাস না করা।
  • সহবাসের সময় স্ত্রীর সহিত বেশি কথা না বলা ।
  • জোহরের নামাজের পরে স্ত্রী সহবাস না করা। ১৫. ভরা পেটে স্ত্রী সহবাস না করা।
  • উল্টাভাবে স্ত্রী সহবাস না করা।
  • স্বপ্নদোষের পর গোসল না করে স্ত্রী সহবাস না করা।

স্ত্রী সহবাসের পর তৎক্ষণাৎ গোসল এবং কিছু ভুল ধারণা

প্রশ্ন: সহবাস এর পরপরই কি গোসল করতে হবে? যদি ভুল বশত: না করা হয় তাহলে উপায় কি?

উত্তর: গোসল ফরজ হলে সালাতের পূর্ব পর্যন্ত গোসল বিলম্ব করা জায়েজ আছে:

স্ত্রী সহবাস, স্বপ্নদোষ ইত্যাদির কারণে গোসল ফরজ হলে তৎক্ষণাৎ গোসল করা আবশ্যক নয়। বরং ঘুম, ব্যস্ততা বা প্রয়োজনে বিলম্ব করা জায়েজ আছে। এ মর্মে একাধিক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যেমন:

১) হাদিসে এসেছে:

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّهُ لَقِيَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فِي طَريقٍ مِنْ طُرُقِ الْمَدِينَةِ وَهُوَ جُنُبٌ فَانْسَلْ فَذَهَبَ فَاغْتَسَلَ فَتَفَقَّدَهُ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا جَاءَهُ قَالَ ” أَيْنَ كُنتَ يَا أَبَا هُرَيْرَةَ ” . قَالَ يَا رَسُولَ اللهِ لَقِيتَنِي وَأَنَا جُلُبٌ فَكَرِهْتُ أَنْ أُجَالِسَكَ حَتَّى أَعْتَسِلَ . فَقَالَ رَسُولُ الله صلى الله عليه وسلم ” سُبْحَانَ اللَّهِ إِنَّ الْمُؤْمِنَ لَا يَنْجُسُ ” .

আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত। তিনি একবার মদিনার কোন এক রাস্তায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সাক্ষাৎ পেলেন। তিনি (আবু হুরায়রা রা.) তখন (জানবাত) অপবিত্র অবস্থায় ছিলেন। এই কারণে তিনি আস্তে করে পাশ কেটে চলে গেলেন এবং গোসল করলেন।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে তালাশ করলেন। পরে তিনি এলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন: আবু হুরায়রা। তুমি কোথায় ছিলে?

তিনি বললেন: হে আল্লাহর রাসূল, আপনার সঙ্গে যখন আমার সাক্ষাৎ হয় তখন আমি অপবিত্র অবস্থায় ছিলাম। তাই আমি গোসল না করে আপনার সাথে উঠবস করাকে অপছন্দ করেছি।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: “সুবহানাল্লাহ! মুমিন তো অপবিত্র হয় না।” (সহিহ বুখারী ও মুসলিম। সহীহ মুসলিম, হাদিস নম্বর/৭১০ অধ্যায়ঃ ৩/ হায়েজ

হাদিসের বক্তব্য: “মুমিন তো অপবিত্র হয় না” এর অর্থ হল, মুমিন অভ্যন্তরিণভাবে কখনো নাপাক হয় না। বাহ্যিকভাবে শরীরে নাপাকি লাগলে শরীর নাপাক হয় কিন্তু তার মধ্যে ঈমান থাকায় সে অভ্যন্তরিণভাবে সে পবিত্র থাকে (জীবিত ও মৃত সর্বাবস্থায়)। পক্ষান্তরে কাফির বাহ্যিকভাবে যদি পরিষ্কারও থাকে তবে ঈমান না থাকার কারণে সে অভ্যন্তরিণভাবে নাপাক।

ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন:

فيه جواز تأخير الاعتسال عن أول وجوبه

“এ হাদিসে গোসল ফরজ হওয়ার পর তা বিলম্ব করার বৈধতা পাওয়া যায়।” (সহিহ বুখারির ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফাতহুল বারী)

২) আরেকটি হাদিসে বর্ণিত হয়েছে,

عن عضيف بن الحارث قال قلت لعائشة أكان النبي صلى الله عليه وسلم يغتسل قبل أن ينام؟ وينام قبل أن يغتسل ؟ قالت نعم قلت الحمد لله الذي جعل في الأمر سعة

গাযীফ ইবনুল হারিস রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আয়েশা রা. কে প্রশ্ন করলাম, নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি ঘুমের পূর্বে গোসল করতেন অথবা গোসলের পূর্বে ঘুমাতেন?

তিনি বললেন: হ্যাঁ।

আমি বললাম: আল হামদু লিল্লাহ-সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি বিষয়টিতে ছাড় রেখেছেন। (সহিহ আবু দাউদ, হা/২২৬)

৩) এ ছাড়াও সহিহ সনদে প্রমাণিত হয়েছে যে,

রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্ত্রী সহবাসের পর শরীর নাপাক অবস্থায় রমাযান মাসে ভোর রাতে সেহরি খেয়েছেন। তারপর ফজরের আজান হলে গোসল করে মসজিদে সালাত আদায়ের জন্য গেছেন।

উল্লেখ্য যে, একটি হাদিসে এসেছে: “যে ঘরে জুনুবি ব্যক্তি (গোসল ফরজ হয়েছে এমন নাপাক ব্যক্তি) এবং কুকুর থাকে সে ঘরে ফেরেশতা প্রবেশ করে না।” এই হাদিসটি মুহাদ্দিসগণের জইফ বা দুর্বল।

তবে সালাতের সময় হলে গোসলের মাধ্যমে পবিত্রতা অর্জন করার পর সালাত আদায় করা আবশ্যক। কেননা সালাতের জন্য পাক-পবিত্রতা অর্জন করা পূর্বশর্ত।

স্ত্রী সহবাসের পর গোসল করতে বিলম্ব করলে ওজু করা মুস্তাহাব:

স্ত্রী সহবাসের পর কেউ ইচ্ছে করলে তৎক্ষণাৎ গোসল করে নিতে পারে আবার ইচ্ছে করলে বিলম্বও করতে পারে। বিলম্ব করতে চাইলে অজু করে নেওয়া উত্তম।

হাদিসে বর্ণিত হয়েছে:

.”في الصحيحين أن عمر استفتى رسول الله صلى الله عليه وسلم أينام أحدنا وهو جنب؟ قال: “نعم، إذا توضأ

ওমর রা. রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নিকট প্রশ্ন করলেন, শরীর নাপাক অবস্থায় কি কেউ ঘুমাতে পারে?

তিনি বললেন: “হ্যাঁ, যদি অজু করে।” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)

قال ابن عبد البر: ذهب الجمهور إلى أنه – أي الأمر بالوضوء للجنب الذي يريد
النوم – للاستحباب

“ইবনে আব্দুল বার বলেন, জুমহুর তথা অধিকাংশ আলেম এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, যে জুনুবি (নাপাক) ব্যক্তি ঘুমাতে চায় তার জন্য ওজু করার নির্দেশ টি মুস্তাহাব পর্যায়ের।”

সহবাসের পর গোসল করা সম্পর্কে কতিপয় ভুল ধারণা ও ভিত্তিহীন কথা:

  • সহবাসের সাথে সাথেই গোসল করতে হবে; নয়তো গুনাহ হবে।
  • সহবাস করে গোসলের পূর্বে মাটিতে পা রাখা যাবে না। অন্যথায় মাটি বদ দুআ করবে এবং অভিশাপ দিবে!
  • সহবাস করার পর গোসলের পূর্বে কোন কিছুতে হাত দেয়া যাবে না। এই অবস্থায় কোন কিছুতে হাত দিলে তা অপবিত্র হয়ে যাবে!
  • এ অবস্থায় রান্না-বান্না করলে বাড়ি থেকে লক্ষ্মী চলে যাবে। (এটি স্পষ্ট শিরক)।
  • গোসলের পূর্বে হাতে কিছু নিয়ে দরজা ধরতে হবে।
  • নাপাক অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া করা যাবে না।
  • এ অবস্থায় রান্না-বান্না করা যাবে না ৷
  • ঘর-বাড়ি ঝাড়ু দেয়া যাবে না।
  • সন্তানকে বুকের দুধ পান করানো যাবে না।
  • অবস্থায় দুআ-তসবিহ, জিকির-আজকার পাঠ করা যাবে না।

এ সবই কুরআন-সুন্নাহ বর্হিভূত ভুল ধারণা ও বাতিল কথা। ইসলামে এ সব কথার কোন ভিত্তি নাই।

আল্লাহ আমাদেরকে দীনের সঠিক জ্ঞান ও বুঝ দান করুন এবং সর্ব প্রকার বাতিল ও কুসংস্কার থেকে হেফাজত করুন। আমিন।