যেভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বাঙালি জাতির জীবনে এক বেদনাবিধুর ও কলঙ্কজনক অধ্যায়। এই দিনে দেশ-বিদেশের স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্যের হাতে ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে বাঙালি জাতির পিতা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হন। সেদিন আরো শহীদ হন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, তিন ছেলেসহ পরিবারের উপস্থিত সব সদস্য, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি কৃষক নেতা আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্যরা এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার পরিবারের সদস্যরা। বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও সেদিন রেহাই পাননি। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও নিহত হন। কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে ১৩ জন নিরীহ মানুষও সেদিন নিহত হন। এ ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ভাগ্যক্রমে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। সেদিন যাদের হত্যা করা হয়েছিল তারা প্রত্যেকেই ছিলেন অত্যন্ত ভালো মানুষ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চরম শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক অবমুক্ত করা দলিলের ভাষ্যমতে, ‘১৫ আগস্টে কতগুলো খাঁটি দেশপ্রেমিক ও সৎ লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাদের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে কিন্তু তাদের দেশপ্রেম ও সততা প্রশ্নাতীত।’

যেভাবে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধুকে

১৫ আগস্টের কালরাতে শেখ কামালকে হত্যার মধ্য দিয়ে হত্যাযজ্ঞের শুরু আর শেষ হয় শিশু শেখ রাসেলকে হত্যার মধ্য দিয়ে।
সেদিন ভোর রাতের আগেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে যান। তখন উপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারি এ এফ এম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। কিন্তু, পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেও কোনো সাড়া শব্দ পাননি মহিতুল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসায় অবস্থান করা তাঁর ব্যক্তিগত সহকারি আব্দুর রহমান শেখ রমা এভাবেই বর্ণনা দিয়েছেন ১৫ আগস্ট হতাকান্ডের। ভোর রাতে ধানমন্ডির বাড়িটি আক্রান্ত হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু যে ঘরে ছিলেন তাঁর বাইরের বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন শেখ রমা।
সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকান্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে যুবনেতা ও শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিনী আরজু মনি ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।
আব্দুর রহমান শেখ রমা ’৬৯ সাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর পরিবারে কাজ করতেন, ’৭১-এ ওই পরিবারের সঙ্গে ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে যে মামলা করা হয় তার দ্বিতীয় সাক্ষি এই রমা।
‘সেদিন ভোর রাতে বাড়িটির দিকে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। বেগম মুজিবের কথায় আমি নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে এসে দেখি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগুচ্ছে। তখন আমি বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন’-বলেন রমা।
পরে রমা দ্রুত দোতলায় গিয়ে দেখেন, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। রমা সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তিনতলায় চলে যান এবং শেখ কামাল ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন। তখন দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায়। পরে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে তারা দ্রুত জামা-কাপড় পরে বেগম মুজিবের কক্ষে যান।’
রমা বলেন, গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল ইসলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কথা শেষ করতে পারেননি। একঝাঁক গুলি জানালার কাঁচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু তখন টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। এর মধ্যেই গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তাঁর পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এতো গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু উপরে চলে যান।
বঙ্গবন্ধু উপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় দাঁড়ান। তখন কোনো কথা না বলেই শেখ কামালের পায়ে গুলি করে বজলুল হুদা। নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে পড়েন শেখ কামাল। বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ্য করে বজলুল হুদা তার হাতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে মারা যান শেখ কামাল।
আব্দুর রহমান রমা বলেন, নিচে কী হচ্ছে তার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তাঁর সামরিক সচিব কর্নেল জামিল উদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, ‘জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো।’
পরে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, ‘সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’
এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে চলে যায়। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থাতে তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়। গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে।
মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। এসময় বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের কাছে তারা কি চায় এবং বঙ্গবন্ধুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তা জানতে চান। এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে।
রমা জানান, দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে শেখ রাসেল এবং তাকে যখন নীচে নিয়ে আসা হয়। তখন রাসেল বলছিলো: ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো? এরকম শিশুকে নিশ্চয়ই খুনিরা মারবে না আশায় মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন: ‘না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না’। পরে রাসেল বলে, ‘আমি মায়ের কাছে যাবো।’
পরে এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলি এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ওই হাবিলদার নীচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে: ‘স্যার, সব শেষ।’
এর আগে আজিজ পাশা এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব,শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ ও উদ্দেশ্য

গুটিকয়েক উচ্ছৃঙ্খল ও উচ্চাভিলাষী অফিসার কীভাবে এ নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটাতে সক্ষম হলো, তা বিশ্লেষণের দাবি রাখে। আমার বিশ্লেষণমতে আমি অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে হত্যাকাণ্ডের কারণগুলো তুলে ধরছি।
ক. সে সময় দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব পড়ে। এমনকি ওই দিন অর্থাৎ ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীকে যদি আদেশ দেওয়াও হতো, সৈনিকেরা সে আদেশ কতটুকু পালন করত, তা নিয়ে অধিনায়কদের মনে বেশ সন্দেহ ছিল। অনেক সৈনিক তখন নিরপেক্ষ মনোভাব পোষণ করত বলে মনে করা হতো। তবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ঘটনায় সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও মর্মাহত হয়েছিলেন। তবে এই অজুহাতে অধিনায়কদের বিদ্রোহ দমনের চেষ্টা না করা সামরিক আইনে গুরুতর অপরাধ।
. কোনোরূপ পেশাগত দক্ষতা ও যোগ্যতা যাচাই না করে শুধু রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক পদে অদক্ষ, অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগদান।
. সেনাবাহিনীতে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অবহেলা এবং অযোগ্য অধিনায়কত্ব। তাই সহজেই হত্যাকারী অফিসারগণ নিজেদের স্বার্থ আদায়ের জন্য সাধারণ সৈনিকদের বিপথগামী করতে সক্ষম হন।
. এ পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পূর্বে নৈশ প্রশিক্ষণের নামে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিপুল সৈন্য নতুন বিমানবন্দরে জড়ো হলো। স্বভাবতই এ নৈশ প্যারেডের সময় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারও এ প্রশিক্ষণে উপস্থিত থাকার কথা। অথচ আমার মনে হয় না, ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের অফিসারগণ নৈশ প্যারেডে উপস্থিত ছিলেন।

. রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রধান দায়িত্ব সামরিক সচিব ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার। অথচ সে সময় রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনো স্থায়ী আদেশ (স্ট্যান্ডিং অর্ডার) ছিল বলে অদ্যাবধি জানা যায়নি।
চ. কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে প্রথম ফিল্ড আর্টিলারির সৈনিকদের ঢাকায় এনে রাষ্ট্রপতির বাড়িতে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার বিষয়টি আমার কাছে বোধগম্য নয়। তা ছাড়া নিরাপত্তা ও আনুষ্ঠানিক গার্ড দুটোই ভিন্ন বিষয়। এ দুটোকে এক করার কথা নয়। ওই প্রথম ফিল্ড আর্টিলারির তত্কালীন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ছিলেন ওই ইউনিটেরই অ্যাডজুটেন্ট। ফলে তিনি প্রহরারত সৈনিকগণকে ধোঁকা দিয়ে হত্যাকারীদের নিয়ে অনায়াসে রাষ্ট্রপতির বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়তে সক্ষম হন।
ছ. সেনানিবাসে এবং রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশপাশে সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দাদের নজর রাখার কথা, বিশেষ করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এটা আরও জরুরি ছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি যে সে সময় সেনানিবাসে কিংবা রাষ্ট্রপতির বাড়ির আশপাশে গোয়েন্দা সংস্থার কেউ কর্তব্যরত ছিল।
পরিস্থিতির এই সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণের পর মনে হচ্ছে, ষড়যন্ত্রকারীদের পরিকল্পনা আগে থেকে না জেনে থাকলেও নতুন এয়ারপোর্ট (বর্তমান বিমানবন্দর) থেকে যখন সৈন্যরা ট্যাংক ও কামান নিয়ে শহরের দিকে রওনা হলো, তখনো গোয়েন্দা সংস্থাসহ সংশ্লিষ্টরা জানলে (যা উচিত ছিল) সতর্কতা ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে এই বর্বর হত্যাকাণ্ড ঘটানো সম্ভব হতো না। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির নিজের পক্ষ থেকেই ফোন করে তাঁর ওপর আক্রমণের খবর সংশ্লিষ্টদের জানাতে হলো, যদিও ওই মুহূর্তে প্রতিরোধ প্রচেষ্টা চালানো হলে রাষ্ট্রপতিকে রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হতো না। তবে খবর পাওয়ার পরপরই সামরিক আইনকানুন অনুযায়ী, সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বিদ্রোহীদের দমনের জন্য সব রকম প্রচেষ্টা গ্রহণ করা উচিত ছিল। আর এটা না করা সামরিক আইনে অন্যায় ও শাস্তিযোগ্য।
পরে শুনেছি, অনেকে মনে করতেন বা এখনো করেন, ওই সময় কোনো রকম ব্যবস্থা নিলে নিজেদের মধ্যে অনেক রক্তপাত হতো। কথা হলো, সামরিক শৃঙ্খলা আইনে এ ধরনের অজুহাত দেখিয়ে অধিনায়কদের নিষ্ক্রিয় থাকার কোনো সুযোগ নেই।

খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ

শেখ মুজিবের হত্যার পর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য খন্দকার মোশতাক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। সরকার গঠন করে তিনি ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির স্থলে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ ধ্বনি প্রচলন করেন। বাংলাদেশবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী কিছু ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চপদে বহাল করেন। এ সময় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে বেশ তত্পর হয়ে উঠল।
ক্ষমতায় এসেই এই সরকার তাড়াহুড়ো করে সামরিক বাহিনীতে পরিবর্তন আনে। জেনারেল ওসমানীকে একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদায় রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা করা হলো। উপসেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করা হলো। আর পূর্বতন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহকে অব্যাহতি দিয়ে তাঁর চাকরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য। তত্কালীন ব্রিগেডিয়ার এইচ এম এরশাদকে মেজর জেনারেল পদে পদোন্নতি দিয়ে উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হলো। এই নিয়ে ভারতে প্রশিক্ষণে থাকাকালে মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে তিনি কর্নেল থেকে দুটি পদোন্নতি পেয়ে মেজর জেনারেল হন, যা সেনাবাহিনীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরো সময় জার্মানিতে ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করেন। তাঁকে সেখান থেকে নিয়ে এসে বিমানবাহিনীর প্রধান করা হলো। বিমানবাহিনীর তত্কালীন প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারের চাকরি রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগের জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হলো। বিডিআরের প্রধান মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ পদে নিযুক্ত করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে বহাল করা হলো। সামরিক বাহিনীর এসব পরিবর্তনে জেনারেল ওসমানী ও শেখ মুজিব হত্যাকারী মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শরীফুল হক (ডালিম) এবং তাদের সহযোগীরা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। কারণ, তখন এই অফিসারগণ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাকের আশপাশে থাকত।
মেজর রশিদ, ফারুক এবং তাদেরই সহযোগীদের হাবভাব ও চালচলন দেখে মনে হতো, দেশ এবং সেনাবাহিনী তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। মেজর ফারুক বঙ্গভবনের একটি কালো মার্সিডিজ গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়াত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন লোকজনের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায় এবং অন্যান্য অনিয়মের অভিযোগ ছিল। খন্দকার মোশতাক এদেরকে তার নিজের নিরাপত্তার জন্য বঙ্গভবনেই থাকতে উত্সাহিত করতেন। এর মধ্যে তিনি সেনাবাহিনীর কোনো সুপারিশ ছাড়াই মেজর ফারুক ও রশিদকে লে. কর্নেল পদে পদোন্নতি দেন। ডালিমকেও সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিয়ে লে. কর্নেল করা হয়। সেপ্টেম্বর মাসে মোশতাক এক অধ্যাদেশ বলে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের কোনোরূপ বিচার বা শাস্তি দেওয়া যাবে না—এই মর্মে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ জারি করেন।