ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট নিতে হয় কেন আর কখন

ডেঙ্গু রোগীদের প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলেও রত্ত পরিসঞ্চালনের কোনো প্রয়োজন নেই, সঞ্চালন করলে রক্ত (হোল ব্লাড) সঞ্চালন করাই শ্রেয়, প্লাটিলেট নয়। ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর রক্তচাপ কমে গেলে, তা রেফার করা ঠিক নয়। ডেঙ্গু শক ৪-৬ ঘণ্টার মধ্যে ম্যানেজ করতে হয়। রক্তচাপ কমের রোগীকে রেফার করলে পথেই রোগী খারাপ হতে পারে।

ক্ল্যাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট সামান্য কমলেও সাধারণত এক লাখের বেশি থাকে। সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর আর ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের মধ্যে পার্থক্য আছে। শুধু জ্বর বা রক্তক্ষরণ হলেই সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলতে হলে প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকতে হবে। সেই সঙ্গে রক্তের হিমাটক্রিট ২০ শতাংশ বেড়ে যাওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে। সঙ্গে থাকতে পারে রক্তনালি থেকে রক্তরস বেরিয়ে আসা বা প্লাজমা লিকিংয়ের সমস্যা (যেমন প্রোটিন কমে যাওয়া, পেটে–বুকে পানি জমা) থাকবে। বিশ্বে প্রতিবছর ১০ থেকে ৪০ কোটি লোকের ডেঙ্গু হয়, এর মধ্যে খুব কমসংখ্যকের হেমোরেজিক ডেঙ্গু হয়ে থাকে। ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট নিতে হয় কেন আর কখন তা নিয়ে আলোচনা করবো:

প্লাটিলেট কমে যাওয়া কেন বিপজ্জনক?

কেবল ডেঙ্গু নয়, আরও নানা রোগে রক্ত সংক্রমণে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমতে পারে। তবে, প্লাটিলেট এক লাখের নীচে নেমে গেলে তাকে জটিল পরিস্থিতি বলে ধরে নেওয়া যায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ সতর্ক করেছেন, এ প্লাটিলেটের সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনও প্রকার আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে। তিনি বলেছেন, রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নামা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় শরীরের যে কোনও জায়গা থেকে অনবরত রক্তপাত হওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি থাকে।

প্লাটিলেট কমে গেলেই কি রক্ত নিতে হয়?

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ জানিয়েছেন প্লাটিলেট কমে গেলেই যে রক্ত নিতে হবে এমনটা নয়। “কেননা ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্লাটিলেট কমে যাওয়াই একমাত্র সমস্যা নয় বরং শরীরের রক্তরস কমে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়াও পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে পারে। সেক্ষেত্রে লক্ষণ অনুযায়ী চিকিৎসা দিলে রোগীকে সারিয়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন নাও হতে পারে,” তিনি বলেছেন।

তিনি বলেন, “বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীর প্লাটিলেট দেয়ার কোন প্রয়োজন হয় না। রক্তে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে যায় খুব কম সময়ের জন্য – হয়তো দুই তিন দিন। এরপর নিজে থেকেই প্লাটিলেট বাড়তে থাকে। তাই আমরা ঢালাওভাবে রক্ত নেয়ার পরামর্শ দেই না।”

“আমাদের রোগীও আছে ১০ হাজার প্লাটিনেট নেমেছে, তাও লাগেনি। রোগী ভালো হয়ে গিয়েছেন। যদি রোগীর রক্তক্ষরণ বেশি হয়, রক্তরস কমে যায়, হিমোগ্লোবিন কমে যায়, প্রেশার কমে যায় তাহলেই রক্ত দেয়ার কথা বলি,” বলেন অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ। আবার অনেক সময় প্লাটিলেটের সংখ্যা বেশি থাকলেও এর কার্যকারিতা কমে যাওয়ার কারণে রোগীর অবস্থার অবনতি হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়লে দেরী না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ। ডেঙ্গু জ্বর নির্ণয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। তবে এনএসওয়ান নামে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু হয়েছে কি না দ্রুত বোঝা যায়। জ্বর হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যে এই পরীক্ষাটি করানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এছাড়া রক্তের সিবিসি (কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট) পরীক্ষা করার মাধ্যমে প্লাটিলেটের সংখ্যা নিরূপণ করা যায়।পরীক্ষায় প্লাটিলেট কম এলেই যে রোগীকে প্লাটিলেট দিতে হবে এমনটি নয় বলে জানিয়েছেন ডা. ঘোষ। সাধারণত চিকিৎসকরা রোগীর বয়স, স্বাস্থ্য পরিস্থিতি বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।

সাধারণত এক ইউনিট প্লাটিলেটের জন্য চারজন দাতার থেকে রক্ত নিতে হয়। এক ইউনিট প্লাটিলেট দিলে ২০ হাজার কাউন্ট প্লাটিলেট বাড়তে পারে।প্লাটিলেট সঞ্চালন বেশ ব্যয়বহুল ও জটিল পদ্ধতি। বাংলাদেশের সব হাসপাতালে রক্ত থেকে প্লাটিলেট পৃথক করার যন্ত্রও নেই। এ কারণে ঘরে ডেঙ্গু রোগী থাকলে আগে থেকেই আশেপাশের কোন হাসপাতালে প্লাটিলেট সঞ্চালনের ব্যবস্থা আছে সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে। সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর জটিল রূপ নিলে বা রক্তক্ষরণ দেখা দিলে সেটাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এক্ষেত্রে রক্ত নেয়ার প্রয়োজন হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য থাকে। প্রথমত প্লাটিলেট এক লাখের নিচে থাকবে, রক্তের হেমাটোক্রিট বা পিসিভি অর্থাৎ প্যাকড সেল ভলিউম বেড়ে যাবে, রক্তনালী থেকে রক্তরস বেরিয়ে আসার সমস্যা দেখা দেবে।

কখন রক্ত নিতে হয়?

ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে মূলত রোগীর রক্তনালীগুলোর দেয়ালে যে ছোট ছোট ছিদ্র থাকে, সেগুলো বড় হয়ে যায়। এতে রক্তনালীর দেয়াল ভেদ করে রক্তের জলীয় উপাদান বা রক্তরস নালির বাইরে বের হয়ে আসে। একে প্লাজমা লিকিংও বলা হয়। এতে রোগীর পেটে–বুকে পানি জমতে পারে। সেইসাথে রোগীর রক্তচাপ কমতে থাকে। প্লাটিলেট কমার চাইতে, রক্তচাপ কমে যাওয়া ডেঙ্গু রোগীর জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. ঘোষ।

প্লাটিলেট কমে যাওয়াসহ এমন আরও কয়েকটি কারণে রোগীর মস্তিষ্ক, কিডনি, হৃদপিণ্ডেও রক্তক্ষরণের আশঙ্কা থাকে। এমনকি হেমারেজিক শকের কারণে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, “যদি আমরা দেখি যে অ্যাকটিভ ব্লিডিং হচ্ছে এবং প্লাটিলেট ২০ হাজারের নীচে নেমে এসেছে, তাহলে আমরা রোগীর পরিস্থিতি বুঝে রক্ত নেয়ার পরামর্শ দেই। তবে ডেঙ্গু রোগীর মূল সমস্যা প্লাটিলেট কমে যাওয়া নয়। এখানে আশঙ্কার জায়গা হল রোগীর রক্তচাপ কমে যাওয়া। কারণ প্রেশার কমে গেলে শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। এতে বিভিন্ন অঙ্গ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।” এসব জটিলতার পাশাপাশি যদি রোগীর রক্তচাপ অনেক কমে যায়, হৃৎস্পন্দন বাড়ে, হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে কমে যায় সেইসাথে অন্যান্য জটিলতা দেখা, তবেই রক্ত দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে।

চিকিৎসকেরা যেসব লক্ষণ দেখলে রক্ত নিতে বলেন, তার মধ্যে রয়েছে –

  • প্লাটিলেট কমে যাওয়ার লক্ষণ।
  • ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ। ত্বকে বেগুনি রঙের ক্ষত দেখা দিবে।
  • শরীরে লাল বা কালো র‍্যাশ দেখা দেয়।
  • মাসিকে অতিরিক্ত রক্তপাত হওয়া।
  • মুখ, মাড়ি বা নাক থেকে রক্তপাত হতে পারে।
  • প্রস্রাব বা মলের সঙ্গে রক্তপাত। কালো রঙের নরম পায়খানা হওয়া।
  • ক্ষতস্থান থেকে বা কোথাও কাটলে অনেকক্ষণ ধরে রক্তপাত হওয়া।
  • অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ ও শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়।

যেসব খাবারে প্লাটিলেট বাড়ে:

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীকে সুষম খাবারের পাশাপাশি তরল জাতীয় খাবার খাওয়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে কিছু খাবার রয়েছে যা খেলে রক্তে কমে যাওয়া প্লাটিলেট আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এমন পাঁচটি খাবার হল:

  • মিষ্টি কুমড়া এবং এর বীজে থাকা ভিটামিন ‘এ’ রক্তে প্লাটিলেট তৈরিতে সাহায্যে করে। তাই ডেঙ্গু রোগীর রক্তে প্লাটিলেট কমে গেলে মিষ্টি কুমড়া খেতে পারে।
  • লেবুর রসে থাকা প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘সি’ রক্তে প্লাটিলেটের পরিমাণ বাড়ায়।এছাড়া শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়ায়। তাই ডেঙ্গু রোগীকে প্রচুর লেবু শরবত খাওয়ানো উচিত।
  • আমলকীতেও রয়েছে প্রচুর ভিটামিন ‘সি’ ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট । আমলকী খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং প্লাটিলেট ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে।
  • রক্তের যেকোনো সংক্রমণ দূর করতেও অ্যালোভেরা খুবই উপকারী। নিয়মিত অ্যালোভেরার জুস পান করলে রক্তের প্লাটিলেট বাড়ে।
  • ডালিম ফলে প্রচুর আয়রন রয়েছে। যা রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে এবং শরীরের দুর্বলতা দূর করতে খুবই ভালো কাজ করে। তাই রোগীর রক্তে প্লাটিলেট বাড়াতে তাকে নিয়মিত ডালিমের জুস খেতে দিন।

মালয়েশিয়ার গবেষণা প্রতিষ্ঠান এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলোজির এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, পেঁপে পাতার রস এবং পাকা পেঁপের জুস ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর রক্তে কমে যাওয়ার প্লাটিলেটের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। সবুজ শাকসবজি, ভিটামিন সি যুক্ত ফল বা তাজা ফলের রস, সেইসাথে ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, প্রোটিন, ভিটামিন কে, ই সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

এক্ষেত্রে প্যাকেটজাত খাবার এবং অতিরিক্ত মসলাদার খাবার এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।