ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?

আপনি কি জানেন? ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়? মানবদেহে ডায়াবেটিস ৪০ mg/dl এর নিচে অথবা ৪০০ mg/dl এর চেয়ে বেশি হলে যেকোন সময় রোগী স্ট্রোক করে মৃত্যু হতে পারে। আবার অনেকসময় দেখা যায়, অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এর কারনে শরীরের যেকোন অঙ্গ যেমন কিডনি, হার্ট, স্নায়ু ইত্যাদি বিকল হয়ে যেতে পারে। যার ফলেও একজন ডায়াবেটিস রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে। যার ফলে বোঝা গেল ডায়াবেটিস অতিমাত্রায় কমে গেলে কিংবা অতিমাত্রায় বেড়ে গেলেই হতে পারে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু। তাই এটা বলার উপায় নেই যে কার ঠিক কত পয়েন্ট হলেই মৃত্যু হতে পারে। চলুন এর কিছু  নমুনাচিত্র দেখে আসা যাক।

ডায়াবেটিস কত হলে মানুষ মারা যায়?

ডায়াবেটিস কি?

মানবশরীরে এক ধরনের হরমোন থাকে যার নাম ইনসুলিন (যা শর্করা নিয়ন্ত্রনে রাখে)। ঠিক যখন থেকে আপনার শরীর প্রাকৃতিকভাবে এই ইনসুলিন উৎপন্ন করা বন্ধ করে দিবে অথবা সঠিক ভাবে কাজ করবে না তখনই বুঝতে হবে আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত।

ডায়াবেটিস কত প্রকার?

ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকারঃ

১। টাইপ-১

২। টাইপ-২

টাইপ-১ঃ টাইপ ১ খুব একটা দেখা যায়না। যাদের টাইপ-১ ডায়াবেটিস হয় তাদের দেহে প্রাকৃতিকভাবেই ইন্সুলিনের ঘাটতি থাকে। যার ফলে তারা ইন্সুলিনের উপর পুরোপুরি নিরভরশীল। আপনি জানলে অবাক হবেন যে, ২০১৭ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী গোটা বিশ্বে প্রায় ৯ মিলিয়ন এর মত মানুষ টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। যার মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই ছিল উচ্চ আয়ের দেশগুলোর।

টাইপ-২ঃ টাইপ-২ সাধারন ডায়াবেটিস এর অন্তর্ভুক্ত। যার মানে হলো ১০০% ভাগের মধ্যে প্রায় ৯৫% মানুষ টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়। এর মূল কারন হল বংশানুযায়ী অথবা অনিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপন। কিন্তু, এটা মোটেও টাইপ-১ এর মত ভয়াবহ না কারন টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধযোগ্য। সঠিক ভাবে চললে, সঠিক খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রন এবং প্রতিনিয়ত ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চললে টাইপ-২ ডায়াবেটিস অচিরেই প্রতিরোধ করা যাবে।

ডায়াবেটিস এর লক্ষণঃ

ডায়াবেটিস এর লক্ষণগুলো শুধুমাত্র যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদেরই জানতে হবে এমনটা  নয়। সচেতনতার জন্য প্রতিটি ব্যক্তিরই ডায়াবেটিস এর লক্ষণ সম্পর্কে  জানা উচিত।সাধারণ কিছু লক্ষণ হলো-

  • বার বার প্রস্রাবের বেগ পাওয়া।
  • অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যাওয়া।
  • ওজন হ্রাস পাওয়া।
  • শরীরে কোনো ঘা শুকাতে দেরী হওয়া।
  • অধিকতর তৃষ্ণা পাওয়া।
  • দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়।
  • অতিরিক্ত ক্লান্ত লাগে।
  • হাত পা অসার অসার হয়ে আসে।
  • ত্বক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি শুষ্ক হয়ে যায়।
  • শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে অধিক সংক্রমণ হয়।

এসব লক্ষণ দেখা গেলেই যে ব্যক্তির   ডায়াবেটিস আছে ঠিক তা নয়। এগুলো ডায়াবেটিস এর প্রারম্ভিক লক্ষণ। এসব লক্ষণ দেখা দিলে  আপনার পারিবারিক ইতিহাস জানতে হবে এবং ডাক্তারের কাছে গিয়ে পরীক্ষা করাতে হবে।

ডায়াবেটিস হলে কি কি সমস্যা হয়ঃ

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ, যার ফলে মারাত্মক সব জটিলতার সৃষ্টি হয়।যেমন-

  • মৃত্যু ঝুঁকি বেড়ে যায়।
  • অন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
  • কিডনি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
  • শরীরের কোনো স্থানে কেটে গেলে তা ভালো হতে চায় না ফলে পঁচন ধরার ভয় থাকে।
  • অল্পতেই শরীর ও চেহারা নষ্ট হয়ে যায় বা বুড়িয়ে যায়।
  • শরীর দূর্বল হয়ে যায়।
  • হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়৷

ডায়াবেটিস কমানোর উপায় কি?

বিবিসির এক জরিপে দেখা যায়,সারা বিশ্বে প্রতি বছর গড়ে ৫৭ লক্ষ মানুষ ডায়াবেটিসের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মারা যায়।WHO  এর মতে, ১৯৮১ সালে ডায়াবেটিস আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিলো ১০৮ মিলিয়ন।আর ২০১৪ সালে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪২২ মিলিয়ন।২০১৯ সালে সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস ও কিডনি রোগে প্রায় ২ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে।তাই ডায়বেটিস কে অবহেলা না করে চলুন জেনে নেই ডায়াবেটিস কমানোর উপায় কি? এখনো পর্যন্ত ডায়াবেটিস প্রতিরোধের উপায় সফলভাবে জানা না গেলেও কিছু কিছু কাজ করলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ ও শারীরিকভাবে ফিট থাকা তাদের অন্যতম। এক গবেষণায় দেখা গেছে দিনে প্রায় ৯০ মিনিট ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করলে ডায়াবেটিস ২৮% রোধ করা সম্ভব। এখনো  যাদের ডায়াবেটিস আছে তারা অনেকেই জানেন না ডায়াবেটিস কমানোর উপায় কি?  ওজন স্বাভাবিক রেখেও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সাথে আরো কিছু উপায় রয়েছে, যেমন –

  • ব্যায়াম
  • খাদ্যাভ্যাস নিয়ন্ত্রণ
  • ওজন সামঞ্জস্য রাখা
  • পরিমিত ঘুম
  • রাত না জাগা
  • ভোরে উঠা
  • ভেজাল খাদ্য পরিহার
  • সময়মতো খাবার গ্রহণ
  • মদ্যপান, নেশা ও ধূমপান ত্যাগ
  • চর্বি ও ফ্যাট জাতীয় খাদ্য পরিহার
  • কোমল পানীয় পরিত্যাগ
  • চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা

ডায়াবেটিস মাপার নিয়মঃ

ডায়াবেটিস নির্ণয় করতে সাধারণত দিনে দুইবার রক্তে সুগার বা চিনির পরিমাণ নির্ণয় করতে হয়। আবার অনেক ডাক্তার বলে থাকেন দিনে কমপক্ষে ৪ বার ডায়াবেটিস মাপা উচিত। দুই বার খালি পেটে আর দুই বার খাওয়ার ২ ঘন্টা পর। ডায়াবেটিস মাপতে হলে কমপক্ষে ১০ ঘন্টা আপনাকে না খেয়ে থাকতে হবে।অর্থাৎ রাতে খেয়ে সকালে খালি পেটে ডায়াবেটিস মাপতে হয়।দুপুরের খাবারের ১ ঘন্টা আগে রক্তে সুগার পরীক্ষা করতে হবে।আবার রাতের খাবারের ঠিক আগেও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে হবে। আপনি হয়তো ভাবছেন বারবার ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা অনেক ঝামেলা। মোটেই কিন্তু তা নয়।এখন আপনি চাইলে ঘরে বসেই ডায়াবেটিস পরীক্ষা করতে পারেন।মাত্র ১ হাজার থেকে ১৫ শত টাকা দিয়েই এখন ডায়াবেটিস মাপার যন্ত্র গ্লুকোমিটার কিনতে পারবেন।

সুগার লেভেল কত হলে ডায়াবেটিস:

 সাধারণত না খাওয়া বা অনাহারী অবস্থায় রক্তে গ্লুকোজ মাত্রা ৬.৫-৭.০ বা এর বেশি হলে ডায়াবেটিস ধরা হয়। কমপক্ষে ৮ ঘন্টা না খেয়ে থাকার পর এই পরীক্ষাটি করা হয়। আবার যদি খাওয়ার পর রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ৮-৯ এর বেশি হয়ে যায় তবে ডায়াবেটিস ধরা হয়।

ডায়াবেটিস কত হলে স্বাভাবিক বা নরমাল:

একজন সুস্থ মানুষের জন্য রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ খালি পেটে ৪-৬ হলো স্বাভাবিক বা নরমাল মাত্রা। আবার আমেরিকান স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান মায়োক্লিনিকের মতে, খালি পেটে ৫.৭ পর্যন্ত হলো স্বাভাবিক মাত্রা। ৫.৭-৬.৪ হলো ডায়াবেটিস এর প্রারম্ভিক অবস্থা। আর যদি আলাদা আলাদা দুটি পরীক্ষায় ৬.৫ এর বেশি হয় তবে ডায়াবেটিস আছে বলে ধরা হয়। আবার খাওয়ার পর ৮ পয়েন্টের নিচে হলে নরমাল। ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীর জন্য খালি পেটে ৪-৭ হলো নরমাল। খাওয়ার পর ৮-৯ পয়েন্ট হলো নরমাল।

ডায়াবেটিস কত হলে ইনসুলিন নিতে হয়?

আপনার রক্তে শর্করার পরিমাণ যদি ১৬.৭  মিলি মোল বা ৩০০ গ্রাম/ডেসিলি. এর বেশি হয় আবার যদি শর্করা গড়ে HBA1 C 10% এর বেশি হয় তবে ইনসুলিন নিতে হবে।আরও

ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসা

এখন পর্যন্ত ডায়াবেটিস রোগের তেমন কোনো চিকিৎসা বা ঔষধ আবিষ্কার হয়নি বা এখনো ক্লিনিক্যাল ট্র‍্যায়ালে ডায়াবেটিস পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য কোনো ঔষধ পাওয়া যায়নি তবে কিছু নিয়ম কানুন ও কিছু ঔষধ সেবন করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যেমন-

  • ওজন নিয়ন্ত্রণ
  • নির্দিষ্ট খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা
  • শারীরিক ব্যায়াম
  • ইনসুলিন গ্রহণ
  • ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন।

ইনসুলিন হলো এখন পর্যন্ত ডায়াবেটিস এর চিকিৎসায় ব্যবহৃত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও একমাত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা এছাড়াও “ডায়াবেট্রল” জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়া হয় রক্তে চিনির মাত্রা কমাতে। তবে কোনোভাবেই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ সেবন করা উচিত নয়।

ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকাঃ

একজন ডায়াবেটিস রোগীর কেমন খাদ্যগ্রহণ করলে ডায়াবেটিস বাড়বে বা কমবে  তা জানা অত্যন্ত জরুরী। আপনার ডায়াবেটিস হলে আপনাকে অবশ্যই সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে।

ডায়াবেটিস হলে কি কি খাওয়া যাবে না

খাদ্য তালিকায় চিনিযুক্ত খাবার,মিষ্টি,জ্যাম,পণির,মাখন,কেক ইত্যাদি বাদ দিলে ঝুঁকি কমে যায়। এছাড়াও হাই প্রেশার থাকলে ঝুঁকি তৈরী হবে এমন খাবার এড়িয়ে চলা উত্তম। রেড মিট বা লাল মাংস,মদ্যপান,ধুমপান ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি বাড়ায়।

ডায়াবেটিস হলে কি কি খাওয়া যাবে?

খাদ্যে সবজির পরিমাণ বাড়ানো উচিত। লাল আটার রুটি,লাল চালের ভাত,আঁশযুক্ত শাকসবজি ইত্যাদি খাওয়া যাবে। ডায়াবেটিস এর রোগীদের আমিষ বা প্রোটিনে কোনো সমস্যা নেই তবে উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে খাওয়া ভালো। তবে অল্প আঁশ সমৃদ্ধ মিষ্টি ফল,ময়দাজাত খাবার,দুধ, আতপ চাল ইত্যাদি একটু এড়িয়ে চলাই মঙ্গল বা কম খাওয়া উচিত।

ডায়াবেটিস কি চিরতরে নিরাময় হবে?

যারা ইতোমধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে গেছেন তাদের ডায়াবেটিস এখন পর্যন্ত আবিস্কৃত চিকিৎসায় পুরোপুরি নিরাময় হওয়া সম্ভব নয়। তবে নিয়ম কানুন,সঠিক খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক ব্যায়াম এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ নিশ্চিত হলে  ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে  রাখা সম্ভব। ডায়াবেটিস  একটি ভয়াবহ ব্যাধি,এর সম্পূর্ণ নিরাময়ও আবিষ্কার হয়নি।ডায়াবেটিসের সবচেয়ে খারাপ দিক হলো, এটি আরো বহু রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।তাই প্রতিকারের কথা ভাবার আগে  ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করাটাই বেশি যুক্তিযুক্ত।