চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা

চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা দুইটাই আছে । চিয়া সিড বা চিয়া বীজ মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া হিসপানিকা (Salvia Hispanica) উদ্ভিদের বীজ। চিয়া সিডের আদি জন্মস্থান সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং সেখানকার প্রাচীন আদিবাসি অ্যাজটেক জাতির খাদ্য তালিকায় এই বীজ অন্তর্ভুক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন মায়া এবং অ্যাজটেক জাতির মানুষ চিয়া সিডকে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবাণ মনে করত। তারা বিশ্বাস করত এটা তাদের শক্তি ও সাহস এর প্রতিক। তারা এই বীজকে দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক শক্তিদানের ক্ষমতার জন্য খুব মূল্য দিত।

আসলে, প্রাচীন মায়া ভাষায় ‘চিয়া’ মানে ‘শক্তি’। চিয়া সিড সব ধরণের আবহাওয়ায় হয় এবং এতে পোকামাকড়ের আক্রমণ তেমন হয় না। চিয়া বীজ সাদা ও কালো রং এর এবং তিলের মত ছোট সাইজের হয়।চিয়া একটি সুপার সিড যাতে আছে প্রচুর পরিমানে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, কোয়েরসেটিন(Quercetin)এসিড,(Caffeic acid) নামক এন্টিঅক্সিডেন্ট,কেম্পফেরল(Kaempferol) ক্লোরোজেনিক এসিড(Chlorogenic acid) এবং ম্যাগনেশিয়াম,ক্যাফিক পটাশিয়াম, এবং দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় আঁশ।

চিয়া সিড অনেকে‌ উপকারী গুনাগুন সম্পন্ন। তবে প্রতিটা জিনিসের কিছু উপকারী ও অপকারী দিক থাকে। ঠিক তেমনি চিয়া সিড এর কিছু উপকারী ও অপকারী দিক রয়েছে। চলুন চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা

চিয়া সিড কি?

চিয়া সিড হচ্ছে মরুভূমিতে জন্মানো সালভিয়া উদ্ভিদের বীজ। এটি মধ্য আমেরিকার অনেক অঞ্চলে পাওয়া যায়। এটি সাধারণত শস্যের তালিকায় পড়লেও একে এক ধরণের ভেষজও বলা হয়। প্রাচীন অ্যাজটেক জাতির প্রধান খাদ্য তালিকায় এটি অন্তর্ভুক্ত বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করে থাকে। চিয়া সিড দেখতে অনেকটা তিলের দানার মতো হয়‌।

চিয়া সিডের পুষ্টিগুণ

চিয়া সিডের পুষ্টিগুণ গবেষক থেকে শুরু করে পুষ্টিবিদ, শেফ-এর মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। চিয়া সিড একটি শক্তিশালী পুষ্টির পাঞ্চ প্যাক, যা ফাইবার, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিন, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, প্রয়োজনীয় ভিটামিন এবং খনিজে সমৃদ্ধ। এখানে প্রতি ১০০ গ্রাম চিয়া সিডের আনুমানিক পুষ্টিরমান দেওয়া হলো।

  • ক্যালোরি: ৪৮৬ কিলোক্যালোরি
  • কার্বোহাইড্রেট: ৪২ গ্রাম
  • ফাইবার: ৩৪.৪ গ্রাম
  • প্রোটিন: ১৬.৫ গ্রাম
  • চর্বি: ৩০.৭ গ্রাম (অধিকাংশ স্বাস্থ্যকর চর্বি)
  • ক্যালসিয়াম: ৬৩১ মিলিগ্রাম
  • আয়রন: ৭.৭ মিলিগ্রাম
  • ম্যাগনেসিয়াম: ৩৩৫ মিলিগ্রাম
  • ফসফরাস: ৪৮০ মিলিগ্রাম
  • পটাসিয়াম: ৪০৭ মিলিগ্রাম
  • জিঙ্ক: ৪.৬ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন বি ১(থায়ামিন): ০.৬২ মিলিগ্রাম
  • ভিটামিন বি ৩(নিয়াসিন): ৮.৮ মিলিগ্রাম
  • চিয়া সিড খাওয়ার নিয়ম

চিয়া সিডের নিজস্ব কোন স্বাদ নেই এজন্য এটা সালাদ, কাস্টার্ড, স্মুদি এই জাতীয় খাবারের সাথে মিশিয়ে খেতে হয়।তবে চিয়া সিড খাওয়ার আগে অবশ্যই ৩০ মিনিট পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন তাহলে ভালো উপকার পাবেন।

দ্রুত ওজন কমাতে খালি পেটে সকালে ও রাতে ঘুমানোর আগে ১ গ্লাস পানির মধ্যে ২ চা চামচ চিয়া সিড ও ২ চামচ লেবুর রস মিশিয়ে খেলে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।

পুডিং

চিয়া পুডিং করার জন্য একটি পাত্রে কিছুটা পরিমান দুধের সাথে মধু বা ম্যাপেল সিরাপ ও চিয়া সিড মিশ্রিত করুন। আপনি ভ্যানিলা নির্যাস বা কোকো পাউডারও মেশাতে পারেন। মিশ্রণটির ওপর থেকে আপনার পছন্দ মতো ফল, বাদাম ছড়িয়ে দিন। তারপর ৮ ঘন্টা মতো রেফ্রিজারেটরে রেখে দিন।

স্মুদি

যে কোনোরকম স্মুদিতে চিয়া সিড মিশিয়ে খেতে পারেন।

স্যালাড

স্যালাডের ওপর চিয়া সিড ছড়িয়ে খেতে পারেন।

ঘরে তৈরি জ্যাম

একটি পাত্রে আপনার পছন্দ মতো ফল, মধু ও চিয়া সিড মিশিয়ে জ্যাম তৈরি করুন। সকালে ব্রেক-ফাস্টে রুটির সাথে এই জ্যাম উপভোগ করুন।

চিয়া সিডের উপকারিতা

চিয়া সিডে রয়েছে উচ্চ ফাইবার, যা হজম শক্তি,রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে,ও ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে । চিয়া সিডে পাওয়া ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড শরীরে প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে সহায়তা করে। চলুন চিয়া সিডের উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিই:

১) শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে চিয়া সিডের উপকারিতা অপরিসীম। চিয়া সিডে থাকা উচ্চ ফাইবার দীর্ঘ সময় ধরে আপনার পেট ভর্তি রাখে এবং যে কোনো অতিরিক্ত ক্যালোরি সমৃদ্ধ খাওয়ার গ্রহণে বাধা দেয়। যার ফলে ওজন নিয়ন্ত্রনে থাকে। চিয়া সিডের দ্রবণীয় ফাইবার আমাদের শরীরের হজম প্রক্রিয়াকে ধীর করে দেয়, যা ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। চিয়া সিডের উচ্চ ফাইবার এবং প্রোটিন উপাদান রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রাখে। চিয়া সিডে রয়েছে ফাইবার, প্রোটিন,ওমেগা- ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, এবং বিভিন্ন খনিজ, যা আপনার শরীরে অতিরিক্ত ওজন কমাতে ব্যাপক সাহায্য করে। এ ছাড়াও‌ এতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সহ স্বাস্থ্যকর চর্বি রয়েছে। এই চর্বিগুলো আপনার শরীরের কার্যকারিতাকে উন্নত করে। চিয়া সিড খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনি সন্তুষ্ট বোধ অনুভব করবেন। এজন্য চিয়া সিড শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।

২) শরীরের হজম শক্তিকে উন্নত করতে চিয়া সিডের ভূমিকা রয়েছে। চিয়া সিড দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় উভয় খাদ্যতালিকাগত ফাইবারের একটি চমৎকার উৎস। নিয়মিত অন্ত্রের গতিবিধি বজায় রাখতে এবং একটি স্বাস্থ্যকর পাচনতন্ত্রের জন্য ফাইবার অপরিহার্য। চিয়া সিড পরিপাকতন্ত্রকে হাইড্রেটেড রাখতে সাহায্য করে। স্বাস্থ্যকর হজমের জন্য সঠিক হাইড্রেশন অপরিহার্য। আপনি যদি হজমের সমস্যায় ভুগে থাকেন, তাহলে দিনে দু’বার জল, দুধ বা যে কোনো তরলে ভিজিয়ে রাখা চিয়া সিড খান। একটি সুষম খাদ্যতালিকায় চিয়া সিড অন্তর্ভুক্ত করুন এবং তার সঙ্গে নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপ করুন, যা আপনার হজম সংক্রান্ত নানান সমস্যার সমাধান করে হজমের উন্নতিতে সাহায্য করে।

৩) চিয়া সিড কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। চিয়া সিডে থাকা দ্রবণীয় ফাইবার পানি শোষণ করে এবং পরিপাকতন্ত্রে জেলের মতো পদার্থ তৈরি করে।‌‌ এগুলো মলকে নরম হতে সাহায্য করে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে মুক্তি দেয়।

৪)অন্ত্রের স্বাস্থ্যের জন্য চিয়া সিডের উপকারিতা রয়েছে। চিয়া সিড প্রিবায়োটিক হিসেবে কাজ করতে পারে, যা অন্ত্রে উপকারি ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।চিয়া সিড খেলে পেটের যে কোনো সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

৫)হার্টের সুস্থতায় চিয়া সিডের উপকারিতা রয়েছে। চিয়া সিডে থাকা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড হার্ট সুস্থ রাখতে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতাকে উন্নত করতে সাহায্য করে।

৬)ডায়াবেটিস প্রতিরোধে চিয়া সিডের উপকারিতা রয়েছে। চিয়া সিডে আছে প্রচুর পরিমানে ফাইবার যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটি টাইপ-২ ডায়াবেটিসের পক্ষে খুবই উপকারি।

৭)হাড়ের মজবুতিতে চিয়া সিডের উপকারিতা রয়েছে। চিয়া সিডে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও ফসফরাস, যা হাড়কে মজবুত রাখে।

৮)অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমাতে চিয়া সিডের উপকারিতা রয়েছে। চিয়া সিড অধিক পরিমানে অ্যান্টি অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ, যা আপনাকে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও শরীরে ইলেক্টোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে এই চিয়া সিড।

৯) চিয়া সিড‌ সিলিয়াক রোগ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করে । চিয়া সিডগুলি প্রাকৃতিকভাবে গ্লুটেন মুক্ত। এই সিড সিলিয়াক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ডায়েটে সংযোজন করা যেতে পারে।

চিয়া সিডের অপকারিতা

প্রতিটি ভাল খাবারের এই উপকারিতা ও অপকারিতা রয়েছে। তেমনি চিয়া সিডেরও কিছু উপকারিতা রয়েছে। চলুন চিয়া সিডের অপকারিতা সম্পর্কে জেনে নিয়:

১) বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে যে অতিরিক্ত চিয়া সিড খাওয়া প্রোটেস্ট ক্যান্সার এবং স্তন ক্যান্সারকে বাড়িয়ে তুলতে পারে। সুতরাং এটি সীমিত পরিমাণে ব্যবহার করা উচিত।

২)চিয়া সিড বেশি খেলে পেটের সমস্যা হতে পারে। কারণ চিয়া বীজের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার। তাই অল্প পরিমাণে চিয়া সিড খাওয়া উচিত। আর স্বাস্থ্য সমস্যা মনে হলে সাথে সাথে এটি খাওয়া বন্ধ করা উচিত।

৩)অতিরিক্ত চিয়া সিড খেলে অস্বাভাবিকভাবে ওজন কমে যেতে পারে।

৪)চিয়া সিড দেহের শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে রক্তচাপ কমায়। তাই অতিরিক্ত চিয়া সিড সেবনে রক্তচাপ বেশি কমে যাওয়ান সম্ভাবনা থাকে।

৫)চিয়া সিড অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়ার ফলে বমি, বমি বমি ভাব, এমনকি ডায়রিয়া হতে পারে।

৬)চিয়া সিড অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে ফোলাভাব সৃষ্টি হতে পারে।

৭)চিয়া সিড খাওয়ার ফলে অনেক ব্যক্তির অ্যালার্জি হতে পারে।

৮)চিয়া সিড খাওয়ার ফলে অনেক সময় জিহ্বা, ঠোঁটে চুলকানি হতে পারে।

সবশেষে

চিয়া সিড সারা বিশ্বে সুপারফুড হিসাবে প্রচুর বিখ্যাত। প্রচুর পুষ্টিগুণ সম্পন্ন চিয়া সিড মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী । তবে এত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ার কারণে অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়া ক্ষতিকর। তাই চিয়া সীড অনেক গুনাগুন সম্পূর্ণ হলেও এটা পরিমাণ মতো খাওয়া উচিত। আশা করি আজকের এই আর্টিকেলটি থেকে আপনি কিছুটা হলেও উপকৃত হয়েছেন। আমাদের সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।