কবরের আজাব

কবর পরজগতের প্রথম ঘাঁটি। নেককাররা সেখানে থাকবেন বেহেশতের আরামে, আর বদকাররা থাকবে জাহান্নামের আজাবে। আজাব বা আরাম চলতে থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষ্য মতে, ‘কবর হবে জান্নাতের বাগান অথবা জাহান্নামের গর্ত।’ জামে তিরমিজি : ২৪৬০

অন্য হাদিসে এসেছে, ‘কবর আখেরাতের প্রথম মঞ্জিল, কেউ তা থেকে রক্ষা পেলে পরের ঘাঁটিগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হবে এবং তা থেকে রক্ষা না পেলে পরের ঘাঁটিগুলো পাড়ি দেওয়া কঠিন হবে।’ জামে তিরমিজি : ২৩০৮

কবরের আজাব থেকে আশ্রয় চেয়ে নবী করিম (সা.) দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন আজাবিল কাবরি।’ অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কবরের আজাব থেকে পানাহ চাই।’ সহিহ বোখারি : ১৩৭৭

কবরের আজাব সত্য বিষয়। কোরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘আমি তাদের (মুনাফিকদের) দুবার শাস্তি দেব। অতঃপর (পরকালেও) তারা মহাশাস্তির দিকে প্রত্যাবর্তিত হবে।’ সুরা তাওবা : ১০১

এখানে দুবার বলতে একবার দুনিয়ায় (ভয়, ক্ষুধা ও যুদ্ধে নিহত হওয়া) এবং আরেকবার কবরের শাস্তির কথা বলা হয়েছে। সুরা গাফেরের ৪৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সকাল-সন্ধ্যায় তাদের উপস্থিত করা হয় আগুনের সামনে এবং যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন বলা হবে ফেরাউন সম্প্রদায়কে নিক্ষেপ করো কঠিনতম শাস্তিতে।’ কবরের শাস্তি বিষয়ে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। দুদিক থেকে কবরের চাপ দেওয়া, সেখানে বধির ফেরেশতার হাতুড়ি দিয়ে পেটানো, জাহান্নামের বিছানা ও পোশাক প্রদান, সেদিকে সুড়ঙ্গ করে দেওয়া ইত্যাদি। কবরের আজাব বিশ্বাস করা আবশ্যক। নতুবা মুমিন থাকা যাবে না। তবে হ্যাঁ, হাসরের মাঠে রায়ের পর জাহান্নামের মূল শাস্তি ও কবরের শাস্তির মধ্যে ব্যবধান আছে; একজন হাজতি ও কয়েদির মধ্যে যেমন ব্যবধান আছে। কিন্তু কবরের আজাব বিষয়ে কিছু প্রশ্ন সবার মনে ঘুরপাক খায়। যেমন আমরা এই আজাব দেখি না, শুনি না কেন? যাদের মাটি না দিয়ে পোড়ানো হয় অথবা কোনো প্রাণী খেয়ে হজম করে ফেলে কিংবা যাদের দেহ মাটিতে মিশে যায় ইত্যাদি লোকদের শাস্তি কীভাবে হয়? এ ধরনের নানান প্রশ্ন মাঝেমধ্যে উঁকি দেয়। তাই বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া দরকার।

প্রথম কথা হলো, শাস্তি দেহের ওপর হয় নাকি রুহের ওপর? উত্তর, কবরের শাস্তি দেহ এবং রুহ দুটির ওপরই হয়ে থাকে। রুহ আল্লাহর নির্দেশমাত্র। সেটা অক্ষত থাকে। সুতরাং তার ওপর শাস্তির বিষয়টি পরিষ্কার। ঘুমন্ত ব্যক্তি স্বপ্নে যত আঘাত বা কষ্ট পায় সবই কিন্তু তার রুহের ওপর হয় দেহের ওপর নয়। তাই আত্মার শাস্তি অনুভব একটি স্বাভাবিক বোধগম্য বিষয়।

আর দেহের শাস্তির জন্য তা কবরে দাফন ও লাশ অক্ষত থাকা শর্ত নয়। এই শাস্তি যেকোনো অবস্থায় যেকোনো স্থানে হতে পারে। লাশ মাটিতে দাফন কিংবা আগুনে পোড়ানো হোক, পানিতে ভাসানো হোক বা কোনো প্রাণী খেয়ে ফেলুক সব জায়গায় সব সময় আল্লাহ শাস্তি দিতে পারেন। এটা তার জন্য সহজ বিষয়। শাস্তির জন্য লাশ অক্ষত থাকার প্রয়োজন হলে পৃথিবীর নিম্নভাগ এত দিনে লাশে ভরপুর হয়ে যেত। নানামুখী সংকটে পড়ত পৃথিবী।

এবার আসা যাক কবরের শাস্তি না দেখা ও শোনা প্রসঙ্গে। এর পেছনে বেশ কিছু রহস্য রয়েছে। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখ করা হলো

১. এটা আল্লাহর করুণা। না হয় আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠত। মৃত মা-বাবা, ভাই-বোন, স্ত্রী, সন্তান ইত্যাদি আত্মীয়দের কবর আজাব যদি শুনতাম আর দেখতাম এবং কিছু করার ক্ষমতা না থাকত তাহলে কীভাবে জীবনযাপন করতাম। ঘুম, খাওয়া, আরাম কোনো কিছু মন চাইত?

২. তা দেখলে বা শুনলে কাফন-দাফন ছেড়ে মানুষ ভয়ে পালাত। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যদি তোমাদের কাফন-দাফন ছেড়ে পালানোর ভয় না করতাম তাহলে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করতাম আমাকে যেভাবে কবরের আজাব শোনানো হয় সেভাবে তোমাদেরও যাতে শোনানো হয়।’ মুসলিম : ২৮৬৮

৩. ব্যক্তির পাপ গোপন রাখাটাও কবর আজাব গায়েব রাখার একটি কারণ। নতুবা ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন দুনিয়াতে লজ্জিত হতো।

৪. কবরের আজাব পরজগতের সঙ্গে জড়িত। দুনিয়ায় তা প্রকাশ করলে জিনিসটি আর গায়েব থাকবে না। মানুষকে পরীক্ষার জন্য তা গোপন করা হয়েছে।

কবরের আজাব থেকে মুক্তি দেবে যে আমল

হজরত উসমান (রা) যখন কবরের পাশ দিয়ে যেতেন, তখন কান্নায় তার দাড়ি ও বুক ভেসে যেত। লোকেরা জিগ্যেস করত, আপনি জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা শুনেও এত বেশি কান্নাকাটি করেন না, কিন্তু কবরের পাশ দিয়ে গেলে এত কান্নাকাটি কেন করেন? তিনি বলেন, আমি হুজুর (স)-এর নিকট শুনেছি, কবর আখেরাতের প্রথম ঘাঁটি। যে ব্যক্তি এখানে নাজাত পেয়ে গেল, তার জন্য সমস্ত মনিজল আসান বা সহজ হয়ে যাবে। আর যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে না, তার জন্য হাশর-নাশর আরও ভয়ানক হয়ে দাঁড়াবে।

তবে রাসুল (স) বলেন, প্রতিদিন এশার নামাজের পর রাতে ঘুমানোর আগে যে ব্যক্তি সুরা তাবারাকাল্লাজি, অর্থাৎ সুরা মুলক তিলাওয়াত করবে, তার মৃত্যুর পর কবরের আজাব মাফ করে দেওয়া হবে। (তিরমিজি-২৮৯০, মুসতাদরাকে হাকেম)।

হজরত আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছে যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; ‘কোরআন শরিফে ৩০ আয়াতবিশিষ্ট একটি সুরা আছে, যা তার তিলাওয়াতকারীকে ক্ষমা করে না দেওয়া পর্যন্ত তার জন্য সুপারিশ করতেই থাকবে। সুরাটি হলো তাবারাকাল্লাজি বি ইয়াদিহিল মুলক, অর্থাৎ সুরা মুলক। (আবু দাউদ-১৪০২, তিরমিজি-২৮৯১, ইবনে মাজাহ-৩৭৮৬, মুসনাদে আহমাদ-২/২৯৯)।

অন্য এক হাদিসে আছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো রাতে সুরা মুলক না পড়ে ঘুমাতেন না (তিরমিজি-২৮৯২, হিসনে হাসিন)। অন্য দিকে আবদুল্লাহ্ বিন মাসউদ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ‘কবরস্থিত ব্যক্তির কাছে পায়ের দিক দিয়ে ফেরেশতারা শাস্তির জন্য আসতে চাইবে। তখন তার পদদ্বয় বলবে, আমার দিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা, সে সুরা মুলক পাঠ করত। তখন তার সিনা অথবা পেটের দিক দিয়ে আসতে চাইবে। তখন সিনা অথবা পেট বলবে, আমার দিকে দিয়ে আসার কোনো রাস্তা তোমাদের জন্য নেই।

কেননা, সে আমার মধ্যে সুরা মুলক ভালোভাবে ধারণ করে রেখেছিল। অতঃপর তার মাথার দিক দিয়ে আসার চেষ্টা করবে। মাথা বলবে, এদিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা, সে আমার দ্বারা সুরা মুলক পাঠ করেছিল। সুরা মুলক হচ্ছে বাধাদানকারী। কবরের আজাব থেকে বাধা দেবে। তাওরাতেও সুরা মুলক ছিল। যে ব্যক্তি তা রাতে পাঠ করে, সে অধিক ও পবিত্র-উৎকৃষ্ট আমল করল। (নাসাঈ)